নারীর প্রতি সংঘবদ্ধ আক্রমণের কারণ
১১ আগস্ট ২০২৩খুলনায় চারজন নারী ফুটবলারের ওপর হামলা হয়েছে তারা এক নারী ফুটবলারের ছবি ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদ করায়৷ এখানে বিষয় ছিলো নারীরা হাফ প্যান্ট ও জার্সি পরে ফুটবল খেলে এটা মানতে পারেনি কেউ কেউ কেউ৷ তাই ছবি ছড়িয়ে দিয়ে কটুক্তি করা হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত হামলা করা হয়েছে৷ হামলার পর পুলিশ ও প্রশাসন সক্রিয় হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ একজন হামলাকারী আটকও হয়েছে৷ তবে এই নারীরা কেন খেলবে? কেন খেলার পোশাক পরবে এটা নিয়ে কিন্তু একটি গোষ্ঠীর সমালোচনার শেষ নেই৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা তৎপর৷ খুলনায় হামলা না হলে হয়তো ছবি ছড়িয়ে কটুক্তির ঘটনাটা আমাদের নজরেও আসত না৷
আমাদের মানসিকতায় সমস্যা আছে ৷ নারীর খেলবে এটা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এর পিছনে ধর্ম যেমন আছে৷ আছে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি৷
আর এ কারণেই এখানে নারী ক্রিকেটার, ফুটবলার জাতীয় দলে বেতন বৈষম্যের শিকার৷ তাই সাফল্য বয়ে আনা নারী ক্রিকেটারদের ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছিলো লোকাল বাসে৷ পুরুষ ক্রিকেটাররা গিয়েছিলেন বিশেষ এসি বাসে৷
সংঘবদ্ধ আক্রমণ বহুমাত্রিক:
গত বছরের জানুয়ারি মাসের ঘটনা৷ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার এক প্রবাসী তরুণী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গিয়ে জিন্সের প্যান্ট, শার্ট আর ওভার কোট পরা একটি ছবি দেন ফেসবুকে৷ আর তাতেই ওই এলাকার কিছু লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে৷ প্রথমে তারা ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্য করে৷ এরপর এলাকায় সালিশ বসায়৷ সালিশে ওই তরুণীর কুলাউড়ায় অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেয়৷ আর এই সিদ্ধান্ত দেয় ওই এলাকার মসজিদ কমিটি৷ মসজিদ কমিটি তার পরিবারকে ওই পোস্ট দেয়ায় ক্ষমা চাইতে এবং পোস্টটি সরাতে বাধ্য করে ৷ শুধু তাই নয়, তারা এনিয়ে কোথাও অভিযোগ করবেন না বলে মুচলেকাও নেয়া হয়৷ পরে বিষয়টি প্রশাসনের কাছে গেলে মসজিদ কমিটি ক্ষমা চেয়ে রেহাই পায়৷
২০১৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নারীদের ফসলের মাঠে ও ক্ষেতে খামারে না যাওয়ার জন্য ফতোয়া দেন স্থানীয় কল্যাণপুর মসজিদের ইমাম ও অনুসারী মুসল্লিরা ৷ আর তা মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয়৷ তাদের দাবি ছিলো, নারীরা ফসলের মাঠে গিয়ে ফসল চুরি এবং কেউ কেউ অসামাজিক কাজ করে৷ পরে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলে পুলিশ ওই ইমামকে আটক করে৷
২০১৫ সালে বগুড়ার শাহজাহানপুরে প্রবাসী এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে রাগের মাথায় তালাক বলায় গ্রাম্য মাতব্বররা প্রথমে ওই পরিবারটিকে ফতোয়া দিয়ে এক ঘরে করে রাখে এবং পরে হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করে৷ হিল্লা বিয়ের পর আবার টেলিফোনে তার স্বামীর সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়৷ ওই নারী এরপর থানায় মামলা করলে পুলিশ যারা ওই ফতোয়া দেন, তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন৷
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গোপালগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে ছয় সদস্যের এক ধর্ষক দল৷ ওই ধর্ষকেরা বন্ধুর সাথে থাকা ওই ছাত্রীকে প্রথমে ইভ টিজিং করে৷ এর প্রতিবাদ জানালে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে৷
কেন এই সংঘবদ্ধ সহিংসতা:
নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়৷ আর এই সহিংসতা ব্যাপ্তি বোঝা যায় তাদের প্রতি সংঘবদ্ধ আচরণে৷ মানবাধিকার কর্মী এবং নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন,"নারীর প্রতি ব্যক্তির যে আচরণ সেটা এই সংঘবদ্ধ আচরণ দিয়েই বোঝা যায়৷ আমাদের সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রে নারীকে হেয় করে দেখা বা ছোট করে দেখার প্রবণতা এখনো কমেছে বলে মনে হয় না৷ পুরুষরা মনে করে নারীরা তারা যেরকম বলবে সেই রকম চলবে৷ তার কোনো ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নাই৷ নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর খেলাধুলা, স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন-এর কোনো কিছুই তাদের সহ্য হয় না৷”
তিনি বলেন,"এর সামাজিক বৈষম্যের যেমন রূপ আছে৷ তেমনি সহিংসতার মাধ্যমেও তা প্রকাশ পায়৷ সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, সংঘবদ্ধভাবে উত্যক্ত করা ওই বিকৃতিরই আরো বড় প্রকাশ৷ তারা মনে করে নারীদের প্রতি ওই আচরণ করলে তাদের কিছু হবে না৷ সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তারা এরকম ধারণাই পেয়েছে৷”
বিশ্লেষকেরা নারীর প্রতি শুধু সংঘবদ্ধ সহিংসতাই নয় নারীকে সংঘবদ্ধ ভাবে অবদমনের শিকার হওয়ার কথাও বলেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী আন্দোলনে যুক্ত নারীদের কটুক্তি করা হয়৷ নানা অসত্য তথ্য প্রচার করা হয়৷ নারীবাদীদের হেয় করে আপত্তিকর কথা বলা হয়৷ শুধু তাই নয় নারী যারা রাজনীতিতে যুক্ত তারাও সংঘবদ্ধ সাইবার আক্রমণের শিকার হন৷ তাদের ছবি বিকৃত করে, কন্ঠ নকল করে অনেক অপপ্রচার করা হয়৷ বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণ নারী রাজনৈতিক নেতা এই সংঘবব্ধ আক্রমণের শিকার৷
সমাজে উগ্রবাদ বাড়ছে:
নারী নেত্রী খুশী কবির মনে করেন,"প্রচলিত নানা কারণের সঙ্গে এখন নতুন করে ধর্মীয় উগ্রবাদ যুক্ত হয়েছে৷ এই বাংলাদেশেই এক সময় কে কী পোশাক পরত তা নিয়ে কেউ ভাবতো না৷ নারী নেত্রীদের, নারী আন্দোলনে যারা যুক্ত তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো৷ এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মনে করে তারা যেরকম চায় সবকিছু সেরকম হতে হবে৷ তাদের মূল টার্গেট নারী৷ আর তারই প্রভাবে নারীরা সংঘদ্ধ আক্রমণ, হেনস্তার শিকার হচ্ছেন৷ তারা মনে করেন কেউ কপালে টিপ পরবে কী না, তা তারা ঠিক করে দেবেন৷ নারীরা ফুটবল খেলবে কী না তাও তারা ঠিক করে দেবেন৷”
তার কথা,"আমরা খেয়াল করি বা না করি রাষ্ট্রে ও সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হলো এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচেছ না৷ তাদের প্রশ্রয়ও দেয়া হচ্ছে৷”
সমাজের অস্থিরতা ও কুসংস্কার:
নারীর প্রতি সংবদ্ধ অপরাধ ও সহিংস আচরণের নেপথ্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাও কাজ করে৷ কাজ করে ধর্মীয় কুসংস্কার৷ আর সমাজে যে অস্থিরতা আছে তারও ও প্রকাশ ঘটে নারীর প্রতি সংঘবদ্ধ সহিংস আচরণে৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন,"নানা সামাজিক চাপ ও অস্থিরতার প্রকাশ ঘটে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মাধ্যমে৷ নারী যেহেতু পরিবার, সমাজে দুর্বল অবস্থানে আছে তাই তার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে৷ আর খুলনায় নারী ফুটবলারদের ওপর হামলার পিছনে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার৷”
"এর ভিতরে রাজনীতিও আছে৷ রাজনৈতিক কারণেও নারী সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়৷ ক্ষমতার বিষয় আছে৷ আসলে এর সঙ্গে আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয়া উগ্রতা, তালেবানি মানসিকতা সব কিছু জড়িয়ে আছে”, বলেন এই মানবাধিকার কর্মী৷ তবে সবার উপরে বিচারহীনতা প্রধান কারণ বলে তিনি মনে করেন৷ তার কথা, "নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই এটা বাড়ছে৷ আর ব্যাক্তি যখন পার পায় তখন সংঘবদ্ধ গ্রুপ মনে করে এটা তো সহজ৷ তাই তারাও সংঘবদ্ধভাবে একই আচরণ করে৷ তারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে৷”
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম মনে করেন, "নারীরা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব সময় সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও চাপের মুখে ছিলো৷ তাই নারী যখন এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন সম্মিলিতভাবে তার চরিত্র হনন করা হয়৷ নারীরা পরিবারের মধ্যেও সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার৷ ” তিনি বলেন,"নারীরা বাইরে খেলাধুলা করবে সেটা নিয়ে আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সব সময়ই একটা সমস্যা আছে৷ যদিও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন৷ তারপরও নারীরা ব্যাডমিন্টন খেলবে, ফুটবল খেলবে, ফুটবল বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হয়, স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে হয়-এটা নিয়ে কুসংস্কার সব সময়ই ছিলো৷ এ কিন্তু আমাদের সমাজ এবং পরিবারেও সমস্যা আছে৷”
তার কথা,"অনেক সংকটের মধ্যেও নারীদের বড় বড় অর্জন আছে৷ তাদের পাশে তাদের পরিবার আছে, অনেকেই আছেন৷ তারপর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বদলাতে হবে৷ এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে৷ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার কাজ নয়৷”