সৌদি আরবে নারী অধিকার
৪ অক্টোবর ২০১২‘ইকেয়া' বা ‘আইকিয়া' নামটা বিদেশে যাঁরা থাকেন তাঁদের অনেকের কাছেই পরিচিত৷ এটা বিশাল এক ‘ইন্টারন্যাশনাল চেন স্টোর' যেখানে ঘরবাড়িতে প্রয়োজন হয়, এরকম যাবতীয় জিনিসপত্র এক ছাদের নীচেই পাওয়া যায়৷ তাদের বৈশিষ্ট্য হলো খুব চমৎকার ফার্নিচার ও অন্যান্য আসবাব তৈরি করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করা৷ নিজস্ব ডিজাইনারদের দিয়ে ডিজাইন করায় বলে ইকেয়া'র পণ্য আধুনিকতার জন্যও খুব প্রসংশিত৷
মূলত সুইডিশ কোম্পানি হলেও, শুধু ইউরোপ নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ‘ইকেয়া' ইতিমধ্যে বেশ নাম কুড়িয়েছে৷ সম্প্রতি তাদের একটি ক্যাটালগ থেকে সৌদি আরবের মেয়েদের ছবি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইকেয়া৷ আর তাতেই যত বিপত্তি৷ সুইডেনের মূল ক্যাটালগে মেয়েদের অজস্র ছবি থাকলেও সৌদি আরবের ইকেয়া ক্যাটালগটিতে মেয়েদের কোনো ছবিই নেই৷ ‘এয়ার ব্রাশ' করে মেয়েদের ছবিগুলোকে মুছে ফেলা হয়েছে৷ জানা গেছে, ক্যাটালগে বাথরুমের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের বিজ্ঞাপণে আয়নার সামনে দাঁড়ানো পাজামা পরা এক নারীও ছিলেন৷ ছবি থেকে সেই নারী হাওয়া৷ অবাক করার মতো বিষয়, তাই নয় কি?
পুরুষতান্ত্রিক সৌদি সমাজে মেয়েদের বহুক্ষেত্রেই কোনো অধিকার নেই৷ সমাজে নারীরা এখনো মর্যাদার স্থান পায়নি, নারী-পুরুষের বৈষম্য অনেক ক্ষেত্রেই খুব পরিষ্কার৷ গাড়ি চালানোর লাইসেন্সটাও নারীর পাওয়া উচিত কিনা এ নিয়ে এখনো বিতর্ক হয় সেখানে৷ আর নারীনিগ্রহের ঘটনা তো হরদম ঘটছে৷ সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশি নারীদের ভয়ংকর যৌন ও দৈহিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবরও প্রায়ই উঠে আসে সংবাদমাধ্যমে৷ তাই বলে মেয়েদের একেবারে বাদ দেয়া? তাও আবার ইউরোপীয় একটি প্রথম শ্রেণির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্যাটালগ থেকে!
বিষয়টি সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রী এওয়া বরলিংকেও অবাক করেছে৷ ইকেয়া'র সরাসরি সমালোচনা না করলেও নারীর প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা লক্ষ্য করে তিনি মর্মাহত৷ সৌদি বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘একটা সমাজ থেকে নারীদের উপস্থিতিকে একেবারে মুছে দেয়া যায় না, তা সে যে ধরণের সমাজই হোক না কেন৷''
না, সৌদি আরবে নারীদের অবস্থা অনেক দেশের তুলনায়ই খারাপ৷ বেশিরভাগ সৌদি পুরুষই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে নারীদের নিজস্ব কোনো আশা, আকাঙ্খা, উচ্চাভিলাস থাকতে পারে না৷ বিয়ের ব্যাপারে তো সৌদি মেয়েদের মতামত নেয়ার কথা ভাবাই যায়না৷ একটি সৌদি মেয়ে যেন পুরুষ বা তাঁর মালিকের সম্পদ, সে তাঁর বাবা, স্বামী বা ভাই – যেই হোক না কেন৷ জীবনের প্রতিটি ধাপে কোনো না কোনো পুরুষই মেয়েটির ভাগ্য নির্ধারক৷ সেখানে এখন সুশিক্ষিত, উচ্চাকাঙ্খী ও দায়িত্বশীল নারীও আছেন বটে, তবে তাঁরাও অনেকটা বন্দীনির মতো৷
কিন্তু তাই বলে সৌদি আরবের নারীরা যে মুখ বুজে আছেন – তাও নয়৷ তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে ধীরে ধীরে হলেও সমাজের চোখ খুলছে৷ ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে আমরা প্রথমবারের মতো সৌদি নারীদের পেয়েছি অ্যাথলেট হিসেবে৷ তাই ইকেয়া'র মতো একটা কোম্পানির এমন আচরণে বেশ ক্ষুব্ধই সৌদি নারীরা৷
‘এয়ার ব্রাশ' করে নারীদের ছবি মুছে ফেলার পেছনে কিন্তু স্থানীয় পরিবেশকদের কোনো হাত ছিল না৷ তাই সুইডেনের ইইউ বিষয়ক মন্ত্রী বির্গিটা ওলসন তাঁর একটি ‘টুইটার' ম্যাসেজে ইকেয়া'র এ সিদ্ধান্তকে ‘মধ্যযুগীয়' বলে মন্তব্য করেছেন৷ ওলসনের কথায়, ‘‘সৌদি আরবে মেয়েদের অস্তিত্ব, তাঁদের কথা বলা অথবা কাজ করা – সবটাই পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল৷ নারী-পুরুষের সমানাধিকার সেখানে অনেক দূরের বিষয়৷ সে জন্য ইকেয়া'র বরং উচিত ছিল নারীদের আরো বেশি করে জনসমক্ষে নিয়ে আসা৷''
‘আল সুলেইমান' সৌদি আরবে ইকেয়া'র একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি দোকান৷ ইউরোপের মতোই বিশাল একটা জায়গা জুড়ে দোকানটা দাঁড়িয়ে৷ এত বড় যে, ঘুরে ঘুরে দেখতে গেলে পথ হারাবার উপক্রম হয়৷ হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পা টনটন করে৷ সারা আতাভিল নিয়মিত পণ্য কেনেন সেখান থেকে৷ ছবি মুছে ফেলার ঘটনা তাঁকেও হতাশ করেছে৷ হতাশা নিয়েই তিনি বললেন, ‘‘আমি নারী, আরব এবং মুসলমান৷ কিন্তু তারপরও আমি মনে করি যে এ কাজটা খুবই বোকার মতো হয়েছে৷ নারী-পুরুষ দুই পক্ষ মিলেই তো বাসযোগ্য করবে আমাদের এ পৃথিবীকে৷''
মজার বিষয়, এমন ঘটনা কিন্তু এবারই প্রথম নয়৷ ১৯৮০ সালে সৌদি আরবে নিজেদের ‘রিটেল-শপ' খোলার পর থেকে বহুবার নারীদের ছবি এভাবে ‘এয়ার ব্রাশ' করে মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ইকেয়া৷ পার্থক্য এটাই যে, এবার এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, হচ্ছে প্রতিবাদ, যা আগে হয়নি৷ আর প্রতিবাদ হচ্ছে বলেই টিম টিম করে হলে আশার আলোও জ্বলছে৷
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ইকেয়া নাকি ইতিমধ্যে তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে৷ মঙ্গলবার স্টকহোমের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তারা ভুল স্বীকার করে বলেছে, ‘সৌদি আরবের জন্য তৈরি ক্যাটালগ থেকে নারীদের একেবারে বাদ দেয়া আমাদের সত্যিই উচিৎ হয়নি৷ এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের আরো একবার ভেবে দেখা উচিত ছিল৷ ইকেয়া গ্রুপের মতাদর্শের সঙ্গেও যে এমন একটা কাজ খাপ খায় না, এটা আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল৷ এর জন্য আমরা সত্যিই দুঃখিত৷'
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: আশীষ চক্রবর্ত্তী