দেড় বছর পর মুখরিত শিক্ষাঙ্গন
করোনা মহামারির কারণে প্রায় ১৭ মাস বন্ধ থাকার পর খুলে দেওয়া হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান৷ এতদিন পর শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসছে শিক্ষার্থীরা৷
পূর্ব প্রস্তুতি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে এমন সিদ্ধান্তের পর স্কুল-কলেজগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠান, প্রাঙ্গন পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ ঢাকার ধানমন্ডি গভর্ণমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা শ্রেণীকক্ষসহ বিদ্যালয়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন৷
সেজেছে বর্ণিল সাজে
দীর্ঘ ১৭ মাস পর শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে স্বাগত জানানোর জন্য ঢাকার ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অগ্রণী স্কুল ও কলেজসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে তারা প্রস্তুত৷
ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা
ঢাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেল, কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ফুল, চকলেট দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে৷ ঢাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে ফুল দিয়ে বরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতে নাচ-গানের আয়োজনও করা হয়েছে৷
স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজে প্রবেশ৷ মাস্ক পড়া নিশ্চিত করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং জীবাণুনাশক স্প্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাত পরিস্কারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন স্কুল ঘরে দেখা গেল শিক্ষার্থীরা হাত পরিস্কার ও মুখে মাস্ক পরে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে৷
আসনসংখ্যার অর্ধেক শিক্ষার্থী
ঢাকার ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অগ্রণী স্কুল ও কলেজসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে একাধিক গ্রুপে ভাগ করে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে আসনসংখ্যার অর্ধেক শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হচ্ছে৷
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঠদানের সূচি
সপ্তাহে কোন শ্রেণির ক্লাস কতদিন হবে এ বিষয়ে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং আগামী ও চলতি বছর যারা এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন, তাঁরা সপ্তাহে ৫ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন৷ বাকি শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ১ দিন আসবেন৷
‘শ্রেণিকক্ষের বিকল্প নেই’
ঢাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষিকা খন্দকার নাসরিন রহমান বলেন, ‘‘করোনার শুরু থেকেই আমরা অনলাইনে ক্লাস নিয়ে আসছি৷ অনলাইনে সবই আমরা করেছি, কিন্তু শিক্ষার্থীদের আগ্রহের মূল জায়গাটা আসলে শ্রেণীকক্ষেই৷ আজকে স্কুলে আসবে ভেবে তাঁরা সবাই আনন্দিত৷ আর অনলাইনে আসলে ইচ্ছা থাকলেও নিজের সবটুকু ঢেলে পড়ানো সম্ভব হয় না৷ শ্রেণিকক্ষের আসলে কোনো বিকল্প নেই৷’’
‘অনলাইন ক্লাসে তেমন আগ্রহ ছিল না’
ঢাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘‘অনেকদিন পর কলেজে এসেছি, অনেক ভালো লাগছে৷ আমরা চাই করোনা পরিস্থিতি ভালো হোক, আমরা যেন নিয়মিত ক্লাস করতে পারি৷ এতদিন অনলাইনে ক্লাস করলেও তেমন আগ্রহ পেতাম না৷ কিন্তু এখন শ্রেনিকক্ষে বসে ক্লাস করছি, সবকিছু নতুন উদ্যমে শুরু করা যাবে৷’’
অভিবাবকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসেছেন সাজেদা আক্তার সুরমা৷ তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে৷ একবার মনে হচ্ছে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, আবার মনে হচ্ছে করোনা আর ডেঙ্গুর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলে দিলেও পারতো৷’’
পরিস্থিতি খারাপ হলে আবার বন্ধ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক ক্ষতির কথা বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও করোনা পরিস্থিতি খারাপ হলে ফের সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হবে৷’’
আইসোলেশন সেন্টার
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে যে সকল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত রাখা৷ কোনো শিক্ষার্থী যদি ক্লাস চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে তাঁকে যেন দ্রুত অক্সিজেনসহ প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যায় প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সে প্রস্তুতি রাখতে হবে৷
খুশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও
ভিকারুন্নিসা স্কুল এন্ড কলেজের পাশে ভ্রাম্যমাণ স্টেশনারির দোকান চালান এমন একাধিক বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাঁদের আয়-রোজগার বন্ধ ছিল৷ যেহেতু অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি ছিল না, তাই সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছিল৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় তারা খুশি৷ করোনার জন্য আর যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা না হয় সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা৷
অনেকেই ঝরে পড়েছে!
সরেজমিনে অনেক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলেই জানা গেছে যে, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এতদিন বন্ধ থাকায় তাঁরা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করতে কাজে যোগ দিয়েছে এবং হয়তো কখনোই তাঁদের পক্ষে আর পড়াশোনা চালানো সম্ভব হবে না৷
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় তীব্র যানজট
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিনে ঐসব এলাকায় তীব্র যানজট দেখা যায়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এলাকায় কর্তব্যরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘আজকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা উপলক্ষে সব সড়কেই যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে৷ কিন্তু তবুও আমরা যানজট কমাতে হিমশিম খাচ্ছি৷ মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা এবং আইন না মানার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে সড়কে এই অবস্থা৷’’