দেশ গড়ার কাজে রত মুক্তিযোদ্ধা জিনাতুন নেসা
২ এপ্রিল ২০১১১৯৪৭ সালের ৯ জুলাই রাজশাহী শহরে জন্ম জিনাতুন নেসা তালুকদারের৷ পিতা মৌলভী পারভেজ আলী মিয়া ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবী৷ ১৯৬৩ সালে রাজশাহীর পিএন সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন জিনাতুন নেসা৷ এরপর কলেজে ভর্তি হন৷ কলেজ জীবন থেকেই সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন৷ তখন সারাদেশে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চলছে৷ তিনিও সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন৷ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন তিনি৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগের একজন নেত্রী হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন৷
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তাঁর ভূমিকার জন্য সরকারের খাতায় রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য চিহ্নিত হয়ে যান জিনাতুন নেসা৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে সরাসরি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি৷ ভারতে গিয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মহেন্দ্র রায় লেনের বিখ্যাত গোবরা ক্যাম্পে কাজ শুরু করেন৷ সেখানে অস্ত্র পরিচালনা ও চিকিৎসা সেবাদানের প্রশিক্ষণ নেন৷ প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে ৭নং সেক্টরের সাব সেক্টর ৪ এর অধীনে দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া ছাড়াও প্রয়োজনে সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়৷
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মধ্যরাতে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি যেতে দেখলাম৷ বাড়ির দরজার সামনে দুই বার পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি থামল৷ তবে আল্লাহর বিশেষ দয়ায় তারা আর ভেতরে আসল না৷ পরের দিন আওয়ামী লীগ নেতার অনুরোধে আমি স্বামী অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ হিল বাকীকে নিয়ে রাজশাহী শহরের হেতেমখা পাড়ায় মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই৷ সেখান থেকে নওদাপাড়ায় যাবার সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের ব্যাগ তল্লাশি করলো৷ সেখানে গিয়ে শুনলাম আমাদের দুই জনের নামে হুলিয়া আছে৷ পরে চব্বিশনগর গ্রামে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের সহযোগিতা করতে থাকলাম আমরা৷ এরপর ১৭ এপ্রিল আমার স্বামী সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গোরা বাজারে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন৷ আর মে মাসে দুইজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমি সীমান্ত পেরিয়ে বহরমপুরে পৌঁছই৷ সেখানে মুর্শিদাবাদ হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কাজ করতে থাকি৷''
এছাড়া দীর্ঘ নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হন জিনাতুন নেসা৷ তাঁর সামনে ঘটে যাওয়া নানা মর্মান্তিক ঘটনা তুলে ধরেন তিনি৷ স্বাধীনতা অর্জনের পরও দেশ ও সমাজসেবায় রত আছেন জিনাতুন নেসা৷ ১৯৭৭ সালে তিনি নওহাটা ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন৷ একইসাথে চালিয়ে যেতে থাকেন রাজনীতি ও সমাজ গড়ার কাজ৷ ১৯৯৬ সালের ৫ জুলাই সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন৷ ১৯৯৭ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেন প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা বিভাগের উপমন্ত্রী হিসেবে৷ বর্তমানেও একজন সাংসদ হিসেবে এলাকার উন্নয়নে ও সরকারের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন জিনাতুন নেসা৷
তাঁর মতে, স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে দ্রুত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমরা দশ বছরের মধ্যেই স্বনির্ভর বাংলাদেশ তথা তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারতাম৷ কিন্তু জাতির বড় দুর্ভাগ্য যে, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা তাঁকে স্বপরিবারে হারিয়েছি৷ তবে আবারও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায় এখন দেশ দ্রুত উন্নতি করছে৷ দেশকে শীঘ্রই ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন একাত্তরের এই সাহসী যোদ্ধা৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন