দেওয়াল ভাঙার উল্লাস কলকাতায়
২১ অক্টোবর ২০১৪গ্রাফিতি বা দেওয়াল-চিত্রের সঙ্গে ভারতের, বিশেষ করে কলকাতা শহরের মানুষ খুবই পরিচিত৷ রাজনৈতিক দেওয়াল লিখন কলকাতার প্রায় সর্বত্র৷ ‘বিজ্ঞাপন মারিবেন না', বা ‘দেওয়াল নোংরা করিবেন না' জাতীয় আবেদন অগ্রাহ্য করেই সরকারি ভবন থেকে গৃহস্থের বাড়ি, সর্বত্র নির্বিচারে দেওয়াল লেখা হয়৷ ভোট দেওয়ার আবদার, মিছিলে যাওয়ার ডাক থেকে পণ্যের বিজ্ঞাপন, দেওয়ালের লাঞ্ছনা চলতেই থাকে৷ অনেকে যদিও মনে করেন, এই দেওয়াল লিখনও কলকাতার এক নিজস্বতা, যাতে শহরটার রাজনৈতিক সচেতনতা প্রকাশ পায়৷ আবার অনেকেই ভাবেন, দেওয়াল লেখাটা এই শহরটার একটা বদভ্যেস, যা শুধু চারপাশটাকে কুশ্রীই করে না, আমাদের সৌন্দর্যবোধের অভাবকেই প্রকট করে৷
পশ্চিমি দেশে এ সংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তা আবার অন্যরকম, যেহেতু ওখানে লোকে ইচ্ছেমতো দেওয়াল নোংরা করে না, দেওয়ালে স্লোগান লিখে বা পোস্টার সেঁটে বেড়ায় না৷ কিন্তু ওসব দেশেও গ্রাফিতি হয়৷ মূলত কমবয়সি, হয়ত একটু প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বা সামাজিক রীতি-নীতি বিরোধী বিপ্লবীয়ানায় বিশ্বাসী তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ই দেওয়ালে লেখা, ছবি আঁকার এই আইন বহির্ভূত কাজটা করে থাকে৷ পুর প্রশাসন বা পুলিশ এ কাজে তাদের বাধা দেয় ঠিকই, কিন্তু কখনও ব্যাপারটাকে বিরাট বড় কোনও গর্হিত অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না৷ বরং পুলিশের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই চোরপুলিশ খেলা, আইনের নজর এড়িয়ে গিয়ে স্প্রে-পেন্টের-ক্যান দিয়ে কোনো দেওয়ালে ছবি এঁকে আসার মতো প্রায় ছেলেমানুষীর পর্যায়েই চালু থেকেছে এই গ্রাফিতি৷ তবে পাশাপাশি একটা ব্যাপারও ঘটেছে৷ একটা গুপ্তবিদ্যার মতো, আন্ডারগ্রাউন্ড আর্ট ফর্মের মতো গ্রাফিতিও শিল্পের এক বেয়াড়া ধারা হিসেবে নিজের ছন্দে বিকশিত হয়েছে৷
বার্লিনের গ্রাফিতিশিল্পী আকিম ভালোটা, যাঁকে আন্তর্জাতিক গ্রাফিতির দুনিয়া জেবস্টার নামে চেনে, তিনি সেই গেরিলা শিল্পেরই একজন ওস্তাদ, যার হাতে রঙের স্প্রে-ক্যান যেন কথা বলে ওঠে৷ কলকাতার জার্মান কনসুলেটের অত্যন্ত রাশভারী চেহারার ধূসর রঙের দেওয়ালে যখন লাল রঙ দিয়ে টানা হাতে বার্লিন শব্দটা লিখলেন, তখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, কী ধুন্দুমার রঙের রায়ট তিনি বাধাতে চলেছেন আর কিছুক্ষণের মধ্যে! আকিম একা নন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিল্লি থেকে আসা ডিজি৷ সুন্দরী মেয়েটি ভারতের হাতে গোনা মহিলা গ্রাফিতি শিল্পীদের একজন৷ কলকাতারও একঝাঁক ছেলে-মেয়ে ছিল ওদের সঙ্গে, যাঁরা বেশ কয়েক বছর ধরেই এই শহরে গ্রাফিতি শিল্পের চর্চা করছেন বলে জানা গেল৷ আর জার্মান কনসুলেটের আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্র, যাঁরা সমান উদ্যমে অংশ নিলেন নতুন ধারার এই শিল্প কর্মশালায়৷
যদিও রাস্তার ধারের দেওয়ালে আঁকার শিল্প, কিন্তু তার পরিকল্পনা বা প্রকৌশলের দিকটা নেহাত হেলাফেলা করার মতো নয়৷ শুরু থেকেই আকিম ভাল্টা দফায় দফায় আলোচনা করছিলেন তাঁর নবীন সহশিল্পীদের সঙ্গে৷যেহেতু এই দেওয়ালচিত্র একাধিক ছোট-বড় ছবি এবং লেখার বর্ণময় সমাহার, তার নকশাটা ঠিক কী হবে, কোথায় কোন রঙের পরত পড়বে, লেখার স্টাইল কী হবে, সেগুলো প্রথমে ছোট ছোট ডিজাইনে এঁকে দেখে নেওয়া হচ্ছিল৷ আঁকতে গিয়ে অনেকেই ভুল করে ফেলছিলেন, বিশেষত আর্ট কলেজের ছাত্ররা, যাঁরা এ ধরণের অঙ্কনরীতির সঙ্গে তেমন পরিচিত নন৷ আকিম তাদের ভুল ধরিয়ে দিচ্ছিলেন, শুধরে দিচ্ছিলেন, ভুলগুলোকেও কী অসামান্য নৈপুণ্যে ছবিতে বদলে ফেলা যায়, দেখিয়ে দিচ্ছিলেন৷ গোটা প্রক্রিয়াটাই এত মজাদার যে পথচলতি মানুষ থেকে শুরু করে কনসুলেট ভবনের কর্মীরা, এমনকি খোদ জার্মান কনসুলার জেনারেল রাইনার শ্মিডশেনও কাজ ফেলে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন৷
কী আঁকা হলো শেষ পর্যন্ত? আঁকা হলো বার্লিনের প্রাচীরের উপর চড়ে বসা মানুষের সারি, বিখ্যাত ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ, সীমান্তের কাঁটাতার লাফিয়ে টপকে আসা এক সৈনিকের ছবি, আর লেখা হলো জার্মান নাগরিকদের সেই অমর উচ্চারণ, আমরাই জনগণ! পূর্ব ও পশ্চিম, দুই জার্মানির বুক চিরে, বার্লিন শহরকে দুভাগ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুখ্যাত প্রাচীর, যা বার্লিন ওয়াল নামে পরিচিত, সংহতিকামী মানুষের দাবিতে সেই দেওয়াল ভাঙা পড়েছিল ১৯৮৯ সালের ৩রা অক্টোবর, ঠিক ২৫ বছর আগে৷ শান্তি এবং মানবিকতার সেই বিজয়ের বর্যপূর্তি উৎসবের জৌলুস যেন আরও বাড়িয়ে দিল কলকাতার জার্মান কনসুলেটের উদ্যোগে এই গ্রাফিতি ও হিপ হপ উৎসব এবং কর্মশালা, যা প্রথম হয়েছিল ২০১১ সালে, ভারত – জার্মান মৈত্রীর ৬০ বছর উপলক্ষ্যে৷