দুর্বল হচ্ছে বন্ধন, বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ
৪ আগস্ট ২০১৭খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দু'টি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিবছর ৫ হাজার ১৪৩টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে৷ দুই কর্পোরেশনের তালাক রেজিস্ট্রি দপ্তর জানাচ্ছে – দিন দিন ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে বিবাহবিচ্ছেদ৷ ঢাকায় এর প্রবণতা ইতিমধ্যেই ভয়ংকর রূপ নিয়েছে৷ এরমধ্যে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ও তারকা পরিবারও রয়েছে৷ বিচ্ছেদের দুই-তৃতীয়াংশ নোটিসই আসছে নারীর কাছ থেকে৷ আর ঢাকা শহরের তুলনায় সারাদেশে এই চিত্র আরও ভয়াবহ৷
বিবাহবিচ্ছেদের নেপথ্যে নানা কারণ দেখছেন মনোবিজ্ঞানীরা৷ তাঁদের মতে, নির্যাতন, মাদকাসক্ত, সন্দেহ প্রবণতা, একে-অপরের অবাধ্য হওয়া, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, পুরুষ নির্ভরশীলতা কমে যাওয়া, আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, স্বাধীনচেতা ও শূন্যতা বিরাজ করা, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, পরকীয়া ও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে৷ এছাড়া রয়েছে আধুনিকতার বিষয়ও৷ তবে স্বাধীনচেতা নারীর জন্য বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখার অবকাশ রয়েছে৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের বন্ধনটা দুর্বল হচ্ছে৷ পাশাপাশি নারীরা সাবলম্বী হচ্ছেন৷ অনেক নারী আগে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও স্বামীর সংসারে থাকতেন৷ কিন্তু এখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন৷ পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোও এখানে ভূমিকা রাখছে৷ স্বামী স্ত্রীকে সময় না দেয়ার কারণে স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন৷ সেখানে কারো সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে৷ এক পর্যায়ে পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন তাঁরা৷ শেষ পর্যন্ত তালাক পর্যন্ত গড়াচ্ছে বিয়ে৷ এখানে একজনের অন্যজনকে বোঝার বিষয় আছে, সময় দেয়ার ব্যাপার আছে, সম্মান দেয়ার বিষয় আছে৷ এগুলো অবহেলা করলে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে রূপ নিচ্ছে৷’’
ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনের ১০ অঞ্চলের হিসাব মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজধানীতে ৩৬ হাজার ৩৭১টি বিবাহবিচ্ছেদের নোটিস দেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে নোটিস কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি৷ দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের নোটিস দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮০৩টি এবং স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাকের নোটিস দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ১৮টি৷ এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে ৫ হাজার ১৪৩টি সংসার বিচ্ছেদ ঘটছে৷
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে জমা পড়া তালাকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মূলত উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে৷ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ বছরে দুই সিটি এলাকায় বিচ্ছেদ কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি, যাঁদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং যাঁরা উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য৷ এছাড়া বিয়ের এক বছর না যেতেই তাঁরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘‘উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কেউ কারও কথা শুনতে চান না৷ তাঁরা যে যাঁর কথা মতো চলেন৷ উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, অঢেল অর্থ সম্পদ রয়েছে, তাই বিচ্ছেদ হলে সমস্যা হবে না৷ আর নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক থাকে বেশি৷ বেশিরভাগ পরিবারের নারীরা চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছুই পান না, অভাব অনটন সব সময় লেগেই থাকে৷ ফলে ঝগড়া, বিবাদ সৃষ্টি হয়৷ অন্যদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণ ঘর ভাঙতে রাজি হন না৷’’
উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘‘আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, এখনকার বাচ্চারা সেভাবে বড় হচ্ছে না৷ তাদের চাহিদা অনেক বেশি৷ তাদের উপর চাপও বেশি৷ তারা খেলার মাঠে যায় না৷ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হয় না, ফলে তারা জানে না বন্ধনটা কী জিনিস৷ এই বাচ্চারা একা একা বড় হচ্ছে৷ তাই বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গেও সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে না৷’’
তবে তাঁর কথায়, ‘‘মূলত নারীর স্বাধীনতা, সচেতনা এবং উপার্জন ক্ষমতা বাড়ায় তাঁরা খুব সহজেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন৷ আসলে আমাদের সংসার টিকাতে হলে স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেই পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে৷ সম্মান করতে হবে৷ ভালোবাসা থাকতে হবে৷ একজনের অন্যজনকে বুঝতে হবে৷ এভাবে চললে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনার কিছু বলার থাকলে জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে...