দুর্দশা, যন্ত্রণার আরেক নাম চা শ্রমিক
ধীরে ধীরে খুলছে বহু বন্ধ বাগান। কিন্তু শ্রমিকের দুর্দশা কমছে না। ন্যূনতম পারিশ্রমিকটুকুও পান না পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকেরা।
একনজরে বাগান
পাহাড়, ডুয়ার্স এবং তরাই মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কমবেশি ২৮৩টি চা বাগান আছে। তার মধ্যে হিমালয়ের পাদদেশে তরাই এবং ডুয়ার্সে বাগানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায চার লাখ কর্মী চা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। তারা বিভিন্ন চা বাগানের বস্তিতে থাকেন।
বন্ধ বাগান
গত এক দশকে প্রায় একশটি চা বাগান বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়, ডুয়ার্স, তরাই সর্বত্র চা বাগান বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিযেছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অভাবে মৃত্যু হযেছে বহু শ্রমিকের। তারই মধ্যে এসেছে করোনাকাল। কাজ বন্ধ থেকেছে খোলা বাগানেরও। তবে ২০২২ সাল থেকে ফের খুলতে শুরু করেছে বহু বন্ধ বাগান। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে প্রায় সব বাগানই খুলে যাবে বলে মনে করছেন চা বাগান আন্দোলনের কর্মীরা।
যন্ত্রণার শেষ নেই
বাগান খুললেও যন্ত্রণা কমেনি শ্রমিকদের। বহু বাগানে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি বাড়ি থেকে কেবল একজন বাগানে কাজ করতে পারবেন। কর্মীদের অভিযোগ, তাদের নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না বাগান মালিকেরা।
কী কী পাওয়ার কথা
মজুরি ছাড়া বাগান শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, রান্নার কাঠ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মীর সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা-সহ একাধিক পরিষেবা দেয়ার কথা বাগান মালিকদের। এর জন্য কর্মীদের মজুরি থেকে টাকাও কাটা হয়। কিন্তু বাস্তবে সব পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে কর্মীদের অভিযোগ।
১৫ শতাংশ বৃদ্ধি
কয়েকমাস আগেও চা কর্মীরা ২০২ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। অতি সম্প্রতি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে তা ২৩২ টাকা করা হযেছে। এই টাকাও তারা সবসময় পান না বলে অভিযোগ। ভারতে এখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩৬৯ টাকা। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই তালিকায় ফেলা হয় না। তাদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি এর চেয়ে অনেক কম। চা কর্মীরা এখন দৈনিক ২৩২ টাকা পান।
অক্লান্ত পরিশ্রম
সকাল সাড়ে সাতটায় বাগানে পৌঁছাতে হয় চা শ্রমিকদের। দুপুরে আধঘণ্টার বিরতি পান তারা। তারপর ফের কাজে নেমে পড়তে হয়। ছুটি হয় চারটের সময়। পাতা তোলার কাজ করেন মূলত মেয়েরা। বাড়ি থেকে জল নিয়ে বাগানে যান কর্মীরা। অভিযোগ, সেই জল শেষ হয়ে গেলে সামান্য খাওয়ার জলটুকুও তাদের দেয়া হয় না। বাগানে জলের ট্যাঙ্ক যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তা পাওয়া যায় না।
এভাবেই থাকে শিশুরা
বাগানের ধারে এভাবেই শিশুদের রেখে কাজে চলে যান মায়েরা। সারাদিন শিশুদের খোঁজও নিতে পারেন না তারা।
মায়ের অপেক্ষায়
মায়ের জন্য অন্তহীন অপেক্ষায় কোলের শিশু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। তাদের কান্নাটুকু শোনার জন্যেও কেউ নেই।
বন্ধ বাগানের কর্মীরা
বন্ধ চা বাগানের কর্মীরা এভাবেই অন্য বাগানে চলে যান ভাগ খাটতে। প্রয়োজন মতো বিভিন্ন বাগান তাদের দিয়ে কনট্রাক্টে কাজ করায়।
ওজন এবং পরোটা
প্রতিদিন দুইবার পাতার ওজন হয়। দিনে গড়ে ২৪ কেজি পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের। বেশি তুললে কেজি প্রতি সাড়ে তিন টাকা করে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু কম তুললেই পরোটা। প্রো রেটা বেসিসে মজুরি কমানো হয়। চা বাগানে সেই প্রো রেটা মুখে মুখে হয়ে গেছে 'পরোটা'।
রেশনের লাইন
আগে চা বাগান থেকে কর্মীদের রেশন দেওয়া হতো। এখন সরকার দেয়। তাই বাগান আর দেয় না। সপ্তাহের চাল-ডাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে কর্মীরা।
মাসের রোজগার
প্রতিদিন কাজ করতে পারলে মাসে হাজার চারেক টাকা রোজগার হয় একজন কর্মীর। সেই টাকা থেকেই বিদ্যুতের বিল, ছেলেমেয়ের স্কুলে খরচ, রান্নার গ্যাস, ওষুধপত্রের টাকা দিতে হয় কর্মীদের।
সরকার কোথায়
চা বাগান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য, বহু আন্দোলনের পর সরকারের হস্তক্ষেপে ১৫ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা নেহাতই কম। চা শ্রমিকদের বক্তব্য, কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের কথা ভাবছে না বলে অভিযোগ।
হতাশ কর্মীদের কথা
হতাশ কর্মীরা পরের প্রজন্মকে আর চা বাগানে রাখতে চান না। চা কর্মীদের নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বক্তব্য, গত কয়েকদশকে বাগান থেকে পালাতে গিয়ে নারীপাচার চক্রের হাতে পড়তে হয়েছে বহু মেয়েকে।