1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইতিহাস গড়ল অভুক্ত মানুষরা

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
১৩ মার্চ ২০১৮

নিপীড়িত কৃষকের ১৩ দফা দাবি নিয়ে নাসিক থেকে মুম্বই পাড়ি দেন ৬০ হাজার কৃষক৷ কাস্তে-‌হাতুড়ির অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে লাল পতাকায় ঢাকা পড়ে বাণিজ্য নগরীর রাজপথ৷ অবশেষে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় বিজেপি সরকার, মকুব হয় ঋণ৷

https://p.dw.com/p/2uEkA
Indien Proteste der Bauern
ছবি: Imago/Hindustan Times/R. Choudhary

সূর্যোদয়ের রক্তিম আভার মতো এদিন জেগে ওঠে লাল পতাকা৷ নাসিক থেকে বাণিজ্য নগরী মুম্বই‌৷ পথটা নেহাত কম নয়৷ ১৮০ কিলোমিটার খালি পায়ে হেঁটে রক্ত ঝরেছে পায়ে, তবু হাঁটা বন্ধ হয়নি৷ অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে অদম্য জেদে ভর করে সুশৃঙ্খলভাবেই এগিয়েছেন তাঁরা৷ আদিবাসী রমনীরা মিছিলে পা-‌মিলিয়ে বলছেন, ‘‌আমিই লেনিন, আমিই স্ট্যালিন!‌'‌

ওঁরা মুম্বই শহরের ঢুকতেই রাজপথে পুস্পবৃষ্টি করে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন অগণিত মানুষ৷ ছাত্ররা তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন জল, বিস্কুটের প্যাকেট, পোহা৷ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি প্রথমদিকে খুব একটা গুরুত্বই দেয়নি৷ কিন্তু শেষমেশ গুরুত্ব আদায় করে নিয়েছেন মেহনতি মানুষরাই৷ মাইলের পর মাইল হেঁটে অবশেষে জয়ী ওঁরা৷

‘‌দাবি আদায় করেই ছাড়ব, সরকারি প্রতিশ্রুতি আর মানব না' – মূলত এই দাবিকে সামনে রেখে নাওয়া-‌খাওয়া ভুলে শুধুমাত্র নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হন কয়েক হাজার কৃষক৷ মুম্বইয়ের রাজপথে তাঁরা ওড়ান প্রতিবাদের লাল ধ্বজা৷ মিছিল মালাডে পৌঁছাতেই হয় পুস্পবৃষ্টি৷ ভিখরোলিতে স্কুল ছাত্র এবং বাসিন্দারা পোস্টার নিয়ে রাস্তার দু'‌পাশে দাঁড়িয়ে কিসানদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন৷ ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ক্ষুধা, তৃষ্ণা নিবারণে এগিয়ে এসেছেন তাঁরা৷ অনেকেই নিজেদের ঘরের দরজা পর্যন্ত খুলে দিয়েছেন৷ দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি দূর করতে এগিয়ে দিয়েছেন জল এবং খাবার৷ রাতভর রাজপথে তাঁদের সেবাযত্ন করেছেন৷ রক্তমাথা পায়ে ওষুধের প্রলেপ দিয়েছেন৷ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে তাঁদের জন্য জুতো-চটি কিনেছেন, যাতে ফেরার পথটা সুগম হয়৷ আন্দোলনকারীদের প্রতি এহেন সহমর্মিতা বহু যুগ দেখেনি ভারত৷ আর বাণিজ্য নগরীর মানুষ যে এতটা মানবিক হতে পারেন, তা এর আগে কখনও ভাবতেও পারেননি মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই খেটে খাওয়া মানুষেরা৷

হান্নান মোল্লা

‘‌অল ইন্ডিয়া কিসান সভা'‌-‌র জাতীয় স্তরের নেতা হান্নান মোল্লার কথায়, ‘‌‘ত্রিপুরার মতো রাজ্যে বাম সরকার নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর কেউ কেউ বামপন্থিদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে, অভুক্ত মানুষ যতদিন থাকবে, গরিব মানুষ যতদিন থাকবে, ততদিন বামপন্থিরা থাকবে৷ আন্দোলন থাকবে৷ এই ভাবেই দাবি আদায় করে নেবে বামপন্থিরা৷ মহারাষ্ট্রের আগে ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়ের কৃষক সভা একইভাবে আন্দোলন করেছে৷ মহারাষ্ট্রে সরকারের কাছে বহুবার দাবি জানানো হয়েছে৷ সরকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে৷ কিন্তু মোদী সরকারের মুখ ও মুখোসের ফারাক বুঝতে দেরি করেনি কৃষকরা৷ তাই একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছে কৃষকের দাবি মেনে নিতে৷'‌'

বিশিষ্ট সাংবাদিক ভোলানাথ ঘোড়ই মনে করছেন, ‘‌‘মহারাষ্ট্রের লং-‌মার্চ ‌সারা পৃথিবীকে আন্দোলন শিখিয়ে দিলো৷ খুব সম্প্রতি ভারতে কিছুটা রাজনৈতিক পথ পরিবর্তন হয়েছে৷ তারপর বামপন্থা ধ্বংস হয়ে গেল, মন একটা প্রচার চলছিল৷ অন্যদিকে, গত কয়েক বছর ধরে অতি ডানপন্থি শক্তি অর্থবলের সঙ্গে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা চলছে৷ কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেল, প্রকৃত ক্ষিদের আন্দোলন হলে সাম্প্রদায়িকতা বানের জলের মতো ভেসে যায়৷ দু-‌এক জায়গায় লেনিনের মূর্তি ভেঙে মানুষকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না৷'‌'

ভোলানাথ ঘোড়ই

অন্যদিকে, অতীতে এমন শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সমাজের অন্যান্যদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে নিজেদের দাবি আদায়ের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ খুব একটা নেই৷ দেশজুড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে৷ তাই পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য দিনের বেলায় পথ দখল না করে আজাদ ময়দানে রাত কাটান কৃষকরা৷ তারপর সারারাত ধরে পথ হাঁটা৷ গরিব, নিপীড়িত কৃষকদের এই সামাজিক চেতনা দেখে অভিভুত মুম্বইবাসীও৷ রক্তঝরা পা-‌গুলোর সেবাযত্ন করতে এগিয়ে এলো অর্ধেক মুম্বই৷

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য৷ আইআইটি বম্বের ছাত্ররা সেখানে আন্দোলনকারী কৃষকদের জন্য খাবার দাবার নিয়ে হাজির হলেন৷ কৃষকদের জন্য জুতো নিয়ে হাজির হয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷

শেষমেশ সেই ক্ষণ এলো৷ কৃষক সভার দাবিকে স্বীকৃতি দিল মহারাষ্ট্রের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার৷ ছ'মাসের মধ্যে কৃষকদের নামে জমি হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ নিজেই৷ মকুব হলো ঋণ৷ এক ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী থাকলো মুম্বই৷ হস্তান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর করতে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে দিলেন ফড়নবিশ৷ সরকারের প্রতিশ্রুতিতে সম্মান দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন কৃষকরা৷

যদিও কষকসভার দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না৷ তবুও মহারাষ্ট্র বিধানসভায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়‌নবিশ বললেন, ‘‌‘‌প্রথমদিন থেকেই কৃষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে৷ আমরা তাঁদের সব দাবি শুনেছি এবং যাবতীয় অভিযোগ দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাব৷'‌'‌

ঘরে বাইরে এই ষাঁড়াশি আক্রমণের মধ্যে ছিলেন তাঁরা৷ শিবসেনা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কৃষকসভার৷ এমনকি কংগ্রেসও সমর্থন জানিয়েছিল তাঁদের৷ ভারতের ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম কোনো বামপন্থি সংগঠনের আন্দোলনের শরিক হয়েছিল বিজেপির শাখা সংগঠন এবং কংগ্রেস৷ সোমবার সকালেই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী টুইটে লিখেছিলেন, ‘‌‘‌ইগো ছেড়ে মাটির মানুষের কথা ভাবুন ফড়নবিশ সরকার৷'‌'‌ পালাবার কোনো পথ ছিল না বিজেপির৷ বাম কৃষক সংগঠনের বিপুল জনমর্থনের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারকে৷

‘‌সারা ভারত কৃষক ক্ষেত মজুর সংগঠন'‌ শুরু থেকেই আন্দোলকে সমর্থন করেছিল৷ সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ বললেন, ‘‌‘‌এই আন্দোলন আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেবে৷ কৃষক যদি রুখে দাঁড়ায় তাহলে শাসককে নতি স্বীকার করতেই হয়৷ অতীতে বাংলায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম এমন আন্দোলন দেখিয়েছে৷ ভবিষ্যতে পুঁজিবাদীদের আবারও এইভাবেই পরাজিত হতে হবে৷''

শঙ্কর ঘোষ

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় দফায় দফায় কৃষক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁদের কথা শুনেছেন৷ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু কৃষকনেতারা তাঁদের জমির অধিকার ছাড়তে রাজি হননি৷ রক্ত জল করা শ্রম দিয়ে যে জমিতে ফসল ফলান, সেই ফসলেই অন্ন সংস্থান হয় রাজ্যবাসীর৷ তার জমিকর অধিকারটুকুই শুধু নিজেদের করতে চেয়েছিলেন তাঁরা৷ দিনের শেষে জয় হয়েছে তাঁদেরই৷ আরব সাগরের পাড়ে সূর্য ডুবলেও৷ কৃষক আন্দোলনের নতুন সূর্য উদয় হলো এখানেই৷

ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই আমরা৷ তাই লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য