তেল নিয়ে তেলেসমাতি
১১ মার্চ ২০২২সরকার পরিস্থিতি সামলাতে লাগাতার অভিযান পরিচালনার পর সয়াবিন তেলের ওপর শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাটও প্রত্যাহার করেছে। পাশাপাশি তেল বিক্রিতে পাকা রসিদের নিয়ম চালু করেছে। ফলে শুক্রবার সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৮ টাকায়ই পাওয়া গেছে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা খুচরা ব্যবসায়ীদের দোকানে অভিযান পরিচালনা করছে। গুদামজাত তেল এমনকি বাথরুম ও মাটির নীচ থেকেও উদ্ধার করা হচ্ছে।
কিন্তু নেপথ্যে যারা আছে বলে অভিযোগ সেই আমদানিকারক ও ডিলাররা কিন্তু থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সরকার সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৮ টাকা বেঁধে দেয়ার পরও তাই বেশ কয়েকদিন প্রতি লিটার ১৮৫ টাকা থেকে ১৯০ টাকায়ও কিনতে হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম টিসিবির ট্রাক সেল। সেখানে লিটার ১১০ টাকা। তাই যত দিন যাচ্ছে, তেলের জন্য লাইন ততই লম্বা হচ্ছে সেখানে।
টিসিবির হিসাব ও বাস্তবতা
সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি বলছে, এক বছরের ব্যবধানে দেশে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে শতকরা প্রায় ৪১ শতাংশ। পাম অয়েলের দাম বেড়েছে শতকরা ৪৯ শতাংশ। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম এক বছর আগে (গত বছরের মার্চে) ছিল ১১৬ টাকা আর এখন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকায়, এক বছর আগে ছিল ১৩০ টাকা।
পাম অয়েল প্রতি লিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকায়, এক বছর আগে ছিল ১০৫ টাকা। তবে টিসিবি সর্বশেষ (বুধবার) সয়াবিন এবং পামের যে বাজারদর প্রকাশ করেছে বাস্তবে তার চেয়ে বাজার মূল্য আরো লিটারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দাম বাড়ানোর জন্য এরইমধ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে।
দাম বাড়ার শীর্ষে সয়াবিন
গত চার বছরে যে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বশি বেড়েছে তার মধ্যে সবার ওপরে আছে সয়াবিন ও পাম অয়েল। ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা। ২০২০ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১৩ টাকা, ২০২১ সালে ১৩০ টকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে এসে হয় ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। এখন ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা।
পামওয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা, ২০২০ সালে লিটারে ৭৮ টাকা, ২০২১ সালে ১০৭ টাকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে হয় ১৫০ টাকা। এখন ১৬৫ টাকা৷
আন্তর্জাতিক বাজার ও আমদানি পরিস্থিতি
বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমাদানি করা হয় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে। এখন বাজারে যে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে তা আমদানি করা হয় গত ডিসেম্বরে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টনের দাম ছিল হাজার ৪১১ ডলার। অন্যান্য খরচ ধরে সেই তেল প্রতি লিটার এখন ১৫২ টাকায় বিক্রি সম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে৷
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। সে হিসেবে তেলের মজুত ও সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। তারপরও বাজারে এখন সয়াবিন তেল স্বাভাবিক মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা আমদানিকারক, তারা তাদের নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুত করে এই সংকট তৈরি করছেন।
গাণিতিক হিসাব
বিশ্ব বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইনডেক্স মুন্ডির' তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে বিশ্ব বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৪১১ ডলার। ট্যারিফ কমিশন থেকে জানা যায়, প্রতি টনে জাহাজ ভাড়া পড়ে ৭০ ডলার। তাই প্রতি টন সয়াবিন তেল চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে এক হাজার ্৪৮১ ডলারে। টাকার অংকে সেটি পড়ে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৬ টাকা (১ ডলার=৮৬ টাকার হিসাবে)। তাই বন্দর পর্যন্ত প্রতি লিটারের দাম পড়ে ১২৭ টাকা ৩৬ পয়সা।
বন্দরে পৌঁছানোর পর ভোক্তার হাত পর্যন্ত যেতে প্রতি লিটারে যোগ হয় আরো ২৫ থেকে ২৭ টাকা। এর মধ্যে আছে মিলে রিফাইনিং খরচ, সরকারি ভ্যাট, এআইটি, ইন্সুরেন্স ব্যয় এবং ব্যবসায়ীদের লাভ। তাই ভোক্তা পর্যায়ে এখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের মূল্য হওয়ার কথা ১৫২ থেকে ১৫৩ টাকা।
তবে এখন বিশ্ব বাজারে সয়াবিনের দাম বেড়েছে। বুধবার প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৭২২ ডলার। এই দামে বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আসবে তিন মাস পরে, এখন যারা এলসি খুলছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক দর দেখে আগে কম দামে আমদানি করা তেলের দাম বাড়িয়ে দেন। দাম কমলে কমান না।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জানতে চান," এখন যে সয়াবিন তেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে তা তিন মাস আগে আনা হয়েছে। তখন তো আর প্রতি টন এক হাজার ৭০০ ডলার ছিল না, তাহলে দাম কেন বাড়বে?”
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমদানি পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। তাদের বাইরে কেউ আমদানি করতে পারে না। আর তারা তাদের ডিলারদের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এখন যে তেল গত তিন মাসে আনা হলো, সরকার তার হিসাব নিলেই ধরা পড়ে যাবে তেল কোথায় আছে। সরকারের ব্যবসায়ী-তোষণ নীতির কারণে সেটা করা হচ্ছে না।
সরকার যদি সয়াবিন তেল আমদানি ‘ওপেন' করে দিতো তাহলে এই পরিস্থিতি হতোনা বলে মনে করেন তিনি।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
গত ২৭ ফেব্রুরি সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। এটা সরকার নাকচ করে দেয়ার পরই ভোজ্য তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। ঠিক পরিবহণ মালিকদের মতো। ডিজেলের দাম বাড়ার পর তারা সরকারের সিদ্ধান্তের আগেই পরিবহণ ভাড়া বাড়িয়ে দেয়।
বাস ভাড়ার মতোই দাম বাড়িয়ে এখন ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা আমদানির ওপর শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন। সরকার এরইমধ্যে তা মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশে ভোজ্য তেল আমদানিকারক ছয়টি প্রতিষ্ঠান হলো: সিটি, মেঘনা, এস আলম, টিকে, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল।
ভোজ্য তেল আমদানিকারক ও মিল মালিক সমিতির সভাপতি এবং টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার চৌধুরী দাবি করেন, তারা সরকার নির্ধারিত ১৬৮ টাকা লিটার দামেই খুচরা বাজারে সয়াবিন তেল দিচ্ছেন। বোতলের গায়ে দাম লেখা থাকে। তবে খুচরা পর্যায়ে বেশি দাম নেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, "এরজন্য আমরা দায়ী না। যারা নিচ্ছে, তারা ঠিক করছে না। এটা অযাচিত। তারা যুদ্ধের সুযোগ নিচ্ছে।”
তার কথা, " তবে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো অথবা ভ্যাট প্রত্যাহারের বিকল্প নেই৷ এখন যে পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম তাতে কয়েক মাস পর ২৩০ টাকা লিটার বিক্রি করতে হবে। আমরা এখন এলসি খুলছি এক হাজার ৮০০ ডলারের বেশি প্রতি টন।”
তিনি দাবি করেন, "গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম শতকরা ১০০ ভাগ বেড়েছে। আর দেশের ভিতরে বেড়েছে তার চেয়ে কম- শতকরা ৬২ ভাগ। দেশের ভোজ্য তেলের ৯০ ভাগই আমদানি করতে হয়। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই।”
তার আশঙ্কা যুদ্ধের কারণে তেলের দাম আরো বেড়ে যাবে।
ট্যারিফ কমিশন দায়ী করছে অসাধু ব্যবসায়ীদের
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য (বাণিজ্য নীতি) শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম গত এক বছর ধরেই বাড়ছে। যুদ্ধের প্রভাবেও কিছুটা বাড়ছে। প্রতি লিটারের সরকার নির্ধারিত দাম ১৬৮ টাকা। এর বেশি দাম নেয়া অন্যায়। কারণ, এর চেয়ে বেশি দাম নেয়ার মতো কোনো কারণ ঘটেনি।”
তিনি বলেন, "পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।”
তার কথা, দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। দেশের ভিতরে সাপ্লাই চেইনকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।