তেল ছাড়া মচমচে হয় না
৫ জুলাই ২০১৯মুঠোবন্দি সেলফোনটার কথা একবার ভাবুন তো—নিমিষেই পেরোনো যায় পৃথিবীর সীমা, বিচরণ করা যায় মহাকাশেও৷
এই সেলফোন কিংবা ইন্টারনেট কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে টেলিভিশনের জন্য৷
টেলিভিশন মানেই দিন জুড়ে নানা আয়োজন৷ সংবাদ, নাটক, সিনেমা, গান, নাচ, আলোচনা—হরেক অনুষ্ঠানমালা৷ আর বিশেষ দিন মানে ঈদ, পূজা-পার্বণ হলে তো অনুষ্ঠানের হিড়িক লেগে যায়৷ নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমে দর্শক ধরে রাখতে চায় সবকটি টেলিভিশন চ্যানেল৷
বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন৷ নানা পসরা সাজিয়েও দর্শক ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে চ্যানেলগুলোর জন্য৷ দর্শকদের অভিযোগ বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে টিভি দেখা দায়৷ রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে যাচ্ছে এই চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে৷ ঠিক মতো দেখা হয় না কোনো অনুষ্ঠান৷
সেলফোন আসক্তি কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে থাকার ফলে মানুষ এখন যেমন বই বিমুখ হয়েছে, তেমনি কমেছে টিভির দর্শক। টিভিতে প্রচারিত নাটক, গান বা কোনো অনুষ্ঠান আলোচনায় এলেই বিকল্প আছে ইউটিউব৷ অযাচিত বিজ্ঞাপন এড়িয়ে নিজের অবসরে দেখা হচ্ছে ওই অনুষ্ঠান৷ নিয়ম করে টিভি সেটের সামনে বসার ঝক্কিটাও নেই!
ইউটিউবে ঘুরে এলে বোঝা যায়, বাংলা নাটকের ভিউ কোটিও ছাড়িয়ে গেছে৷ বাধ্য হয়ে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ঝুঁকতে হচ্ছে ইউটিউবে৷ সেখানে লাখ লাখ ভিউ, বিজ্ঞাপন তো সেখানেই বসতি গড়বে৷ কারণ পণ্যের প্রচারের মোক্ষম হাতিয়ার বিজ্ঞাপন, যেখানে জনসমাগম সেখানে অর্থলগ্নি৷
আবার টিভি চ্যানেলগুলোর প্রেক্ষিতে ভাবলে বিজ্ঞাপন ছাড়া কোনো উপায় নেই৷ কারণ বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলের আয়ের একমাত্র উৎস বিজ্ঞাপন৷ দেশে টিভির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ সেই অনুপাতে বাড়ছে না বিজ্ঞাপনের বাজার৷ ফলে কাঙ্খিত বিজ্ঞাপন না পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ছাটাই করা হচ্ছে৷
ইদানিং বাংলাদেশে নিউজ চ্যানেল তৈরির প্রবণতা বেড়েছে৷ জরিপ বলছে, মিক্সড চ্যানেলগুলোর চেয়ে নিউজের প্রতি মানুষের আগ্রহটা বেশি৷ নিউজ দিয়েও দর্শক ধরে রাখা মুশকিল হচ্ছে৷ আর তাই অনেক টিভি চ্যানেলের খবর ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে লাইভ স্ট্রিমিং হয়৷
এদিকে বেশ কিছুদিন ধরে দেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে৷ কিন্তু এসব চ্যানেল তো আর জোর করে দেখানো হচ্ছে না৷ তাদের অনুষ্ঠানের মান দর্শকদের ভালো লাগছে বলেই তাদের কাটতিও বাড়ছে৷ কথা আসছে, দেশি চ্যানেলগুলো ভারতের এসব বাংলা চ্যানেলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারছে না কেন?
স্টার প্লাস, স্টার জলসা এবং জি বাংলা—এই তিন ভারতীয় চ্যানেল দেশের দর্শকদের বড় একটা অংশ দখল করে রেখেছে৷ বিশেষ করে গৃহস্থ নারীরা এই তিন চ্যানেলের বড় দর্শক৷ দেশীয় চ্যানেলে যখন বিজ্ঞাপনের আধিক্য, তখন ভারতের চ্যানেলে কম বিজ্ঞাপন৷ আর অনুষ্ঠানের মানের দিক তো আছেই৷ ফলে দেশি চ্যানেল ছেড়ে ভারতের চ্যানেলমুখী হচ্ছে মা, বোনেরা৷
আমাদের দেশে অনেক দক্ষ অভিনয় শিল্পী থাকলেও সার্বিক সিস্টেমের কারণে তারাও ব্যর্থ হচ্ছেন৷ কারণ, মানের সঙ্গে আপোশ করেই কাজ করছেন অনেকে৷ মেধা বিকাশের ন্যূনতম সুবিধাটাও পাচ্ছেন না কলা-কুশলীরা৷ কারণ, সবকিছুতেই কম বাজেট৷ তেল ছাড়া মচমচে খাওয়া তো আর সম্ভব নয়! কিন্তু সে চেষ্টাই করতে হচ্ছে নির্মাতাদের৷ অর্থাভাবে দায়সারা অনুষ্ঠান বানাতে পারলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচা৷ বিজ্ঞাপনের অভাব নিয়ে টিভি মালিকরা যতটা সচেতন, এসব সংকট দূরের ক্ষেত্রে ততটা মনোযোগী নয় তারা৷ তার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের অভাব৷ মানুষ টিভি না দেখলে, ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন কেন দেবে?
ভারতীয় প্রোডাকশনে চোখ ফেললেই বোঝা যায়, সেখানে একটা পরিচ্ছন্নতা থাকে৷ তাদের প্রতিটি কাজের জন্য দক্ষ লোকজন নিয়োগ দেয়া হয়৷ ফলে যে যার কাজটা আন্তরিকতার সঙ্গে করার সুযোগ পায়৷
কিন্তু বাংলাদেশে একজন নির্মাতাকে প্রোডাকশনের কাজ পর্যন্ত করতে হয়। আর্টিস্ট কল করা, গাড়ি ঠিক করা সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে কাজ করছেন নির্মাতারা৷ কারণ, একটাই অর্থ সংকট৷ যে বাজেট দেয়া হয়, তা দিয়ে ভালো মানের প্রোগ্রাম করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ ফলে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে৷
এই ফাঁকে ভারতের কিছু চ্যানেল আমাদের জন্য আলাদা ডাউনলিঙ্ক ‘বিম' করে সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে৷ শোনা যায়, বিজ্ঞাপন দাতাদেরও গুণতে হয় তুলনামূলক কম অর্থ৷ এই চ্যানেলগুলোতে দেশীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের সময়টুকু কেবল আমাদের দর্শকরা দেখতে পান৷ ভারতীয় দর্শকরা দেখেন তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন৷ সব মিলিয়ে দেশের বিজ্ঞাপন যাচ্ছে বাইরে৷ কমছে দেশের চ্যানেলের আয়৷ অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো৷
গত কয়েক বছরের প্রাপ্তির হিসেব করলে তেমন কিছুই যোগ হয়নি৷ এখনও নাটকের কথা আসলে দশক আগের উদাহরণ হাজির হচ্ছে৷ অথচ প্রতি ঈদে কয়েকশ নাটক নির্মিত হচ্ছে৷ নির্মাতারা বলছেন, বাজেট সংকট৷ অভিনয় শিল্পীরা বলছেন, ভালো স্ক্রিপ্ট নেই, গল্প নেই৷ মালিকরা বলছেন বিজ্ঞাপন নেই৷
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাজার সম্প্রসারণের যুগে দেশের চ্যানেলগুলোর ‘নাকি কান্না' ধোপে টেকে না৷ বরং দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে হলে, অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে হবে৷ বাড়াতে হবে বাজেট৷ তাঁর অর্থ এটা নয় যে, ভারতের অনুষ্ঠান কপি পেস্ট করা হবে৷ সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে না ছুটে, গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে অবশ্যই৷
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও টেলিভিশনে ভারতীয় পণ্যের প্রভাব কেমন, লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...