তৃণমূল ভাঙবেন শুভেন্দু?
২০ নভেম্বর ২০২০লোকসভা ভোট হোক বা রাজ্যের বিধানসভা ভোট, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা সবসময়ই বিপক্ষ শিবির ভাঙার খেলায় নামেন। বিজেপি-বিরোধী দলের নেতাদের জামাই আদরে হয় দলে নেয়া হয়, অথবা তাঁরা আলাদাভাবে লড়েন। তাতে সুবিধা পায় বিজেপি-ই। পশ্চিমবঙ্গেও তার অন্যথা হয়নি বা হচ্ছে না। লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে চলে এসেছিলেন একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডানহাত বলে পরিচিত মুকুল রায়। মমতার হালহকিকত, তাঁর শক্তি, দুর্বলতা, কাজের ধরণ মুকুলের থেকে ভালো কেউ জানেন না। মুকুল বিজেপি-তে আসায় মোদী-শাহের লাভ হয়েছিল। এখন বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই একই কায়দায় বিজেপি ভাঙিয়ে আনতে চাইছে মমতার আরেক উদীয়মান লেফটন্যান্ট শুভেন্দু অধিকরীকে। মুকুলের সঙ্গে শুভেন্দুর তফাৎ আছে। তৃণমূলে মুকুল ছিলেন ব্যাক রুম পলিটিশিয়ান। পিছন থেকে ভোটের অঙ্ক কষতেন। নেত্রীর সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করতেন। নিজে সেভাবে প্রচারের আলোয় কখনো তিনি আসেননি। তাঁর গুরুত্ব ছিল আলাদা। মুকুলের পিছনে পারিবারিক রাজনীতির জোর ছিল না। জনভিত্তিও নয়। শুভেন্দুর সেই সবই আছে। মেদিনীপুরে নিজের খাসতালুকে শুভেন্দু কার্যত রাজা। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর তো বটেই, রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় তাঁর অনুগামী আছে।
বিধানসভা ভোটের মাস পাঁচেক আগে পশ্চিমবঙ্গে এখন সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হলো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস কি এ বার ভাঙবে? দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত কি বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাবেন শুভেন্দু? শুভেন্দু যে বিজেপি নেতৃত্বের কথা বলছেন, তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে তাঁর তিক্ততা বেড়েছে, তা এখন ওপেন সিক্রেট। কোনো কোনো মহলের দাবি, বিজেপির সঙ্গে শুভেন্দুর কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে শুভেন্দু জনসভা করছেন। কখনো বিজয়া সম্মেলনী নাম দিয়ে, কখনো সমবায় কর্মীদের নিয়ে। কোনোটাই তৃণমূলের ব্যানারে করছেন না। বৃহস্পতিবারই তিনি এরকম একটি জনসভায় বলেছেন, ''তৃণমূল তো আমাকে তাড়ায়নি। আমি এখনো মন্ত্রী আছি। আমিও দল ছাড়িনি।'' উপ মহাদেশের বিচিত্র রাজনীতি এবং বিচিত্র উক্তি। কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
শুভেন্দু এমনিতে খুবই সাবধানী রাজনীতিক। তাঁর খাসতালুক হলো পূর্ব মেদিনীপুর। তাঁর বাবা শিশির অধিকারী অনেকদিন ধরে সেখানে শক্তিসঞ্চয় করেছেন। তারপর সেই প্রতিপত্তি আরো বাড়িয়েছেন তাঁর ছেলেরা, বিশেষ করে শুভেন্দু। ওই এলাকায় অধিকারী পরিবারের দাপট যথেষ্ট। শিশিরবাবু সাংসদ, তিনি আগে কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন। শুভেন্দু রাজ্যে মন্ত্রী, তাঁর ভাই দিব্যেন্দু সাংসদ। আরেক ভাই সৌমেন্দু পুরসভার প্রধান। কাঁথিতে তাঁদের পারিবারিক শাসন চলে।
বিজেপি অবশ্য গান্ধী পরিবারের বাইরে কোনো পরিবার দেখতে পায় না। সে জন্য জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে দলে নিতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। শচিন পাইলটের সঙ্গেও তারা কথা চালাতে পারে। শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়েও তাদের কোনো অসুবিধা নেই। যুদ্ধ ও রাজনীতিতে স্বার্থই শেষ কথা। নীতি নেহাতই লোক দেখানো অবস্থান মাত্র। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, শুভেন্দুর সঙ্গে বিজেপি-র কথাবার্তা চলছে দীর্ঘদিন। বিজেপি নেতারা একবার চেয়েছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দু বেরিয়ে আসুন। কিন্তু তখন তিনি বেরোননি। আসলে শুভেন্দুর গুরুত্ব শুধু মেদিনীপুরের জন্য নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পাঁচটি জেলার সংগঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। শুভেন্দুর সাংগঠনিক দক্ষতা সুবিদিত। এই সুযোগে মুর্শিদাবাদ সহ কয়েকটি জেলায় নিজের কিছু অনুগামী তৈরি করে নিয়েছেন। মমতার তৃণমূলে এক সময় তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছন। বাদ সেধেছে দুইটি ঘটনা। এক, নেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান। দুই, সারদা ও নারদ-কাণ্ডে শুভেন্দুর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। দুর্জনেরা বলেন, সেখান থেকেই চাপের মুখে পড়া শুরু শুভেন্দুর। দলত্যাগ করলে এই দুইটি কারণই হবে মুখ্য।
এখন শুভেন্দু যদি তৃণমূল ছাড়েন, তা হলে সামনে দুইটি বিকল্প থাকবে। হয় নিজের আলাদা দল গঠন করা এবং বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলানো, অথবা, সোজা বিজেপি-তে যোগ দেয়া। দুইটি বিকল্প নিয়েই বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। শুভেন্দু ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এই মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন মন্ত্রী। শুভেন্দু দল ছাড়লে তাতে মমতার ক্ষতি হবেই। পূর্ব মেদিনীপুরের আসনগুলো হাতছাড়া হতে পারে। এ ছাড়াও মুর্শিদাবাদ সহ অন্য চার জেলায়, যেখানে শুভেন্দু দায়িত্বে ছিলেন, সেখানে মমতার ভোট কমতে পারে। বিজেপি-র একাংশ দাবি করছে, শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়লে একা বেরবেন না, বড়সড় ভাঙন ধরিয়ে দেবেন দলে। একগুচ্ছ বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে দল ছাড়বেন।
কোনো সন্দেহ নেই, শুভেন্দু বেরনো মানে মমতার কয়েকটা আসনে ক্ষতি হওয়া। এ বার পশ্চিমবঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। সেখানে কয়েকটি আসন হারানো মানে বড় ক্ষতি। কিন্তু নিজের জেলার বাইরে শুভেন্দু মমতাকে খুব বেশি বিপাকে ফেলতে পারবেন বলে মনে হয় না। আর তৃণমূলের অন্য বিধায়করা বেরোলেও কতটা ক্ষতি হবে, তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থাকছে। কারণ, তৃণমূল দলটাই টিকে আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায়। দলের এক থেকে একশ নম্বরে শুদুই মমতা। মানুষ তাঁকে দেখেই ভোট দেন। এ বারও যাঁরা দেবেন, তাঁরা মমতাকে দেখেই দেবেন, অথবা তাঁর প্রতি ক্ষোভে অন্য দলে ভোট দেবেন।
আর শুভেন্দু যদি নিজের দল গড়তে চান, তা হলে তাতে বিজেপি-র কিঞ্চিত সুবিধা হতে পারে। বিজেপি চাইছে, মমতার ভোট কমাতে। সেখানে তাঁদের অস্ত্র হবে শুভেন্দুর দল। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে দল ভেঙে নিজের দল তৈরি করে সব চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় অজয় মুখোপাধ্যায় বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস করে মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু খুব বেশিদিন প্রভাব বজায় রাখতে পারেননি। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিক আলাদা দল করে চরম ব্যর্থ হয়েছেন। সইফুদ্দিন চৌধুরী, সমীর পুততুন্ডরা পিডিএস করেও সাফল্যের মুখ দেখেননি। শুভেন্দুও কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। শুভেন্দু আর যাই হোন না কেন, মমতার মতো জনপ্রিয় নন। এই জনপ্রিয়তার জন্যই মমতা সাফল্য পেয়েছেন। তাঁকে সাহায্য করেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সিপিএমের নেতৃত্বে বামেদের কিছু ভুলভাল সিদ্ধান্ত। শুভেন্দুর সেই সুযোগ নেই। ফলে তিনি বিজেপি-কে কয়েকটা আসন দিতে পারেন, মমতার কিছু ভোট কাটতে পারেন ঠিকই, তার বেশি কিছু নয়।
তবে বিজেপি-র কাছে শুভেন্দুকে পাওয়াটা বড় কথা। নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। মমতাকে যদি শুভেন্দু সামান্য বেগ দিতে পারেন, তাতেই বিজেপি খুশি। এখন সাবধানী রাজনীতি করা শুভেন্দুকে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা নিতে পারলে ভোটের আগে তৃণমূল ভাঙবে। সেই ভাঙন একটা মানসিক ধাক্কা তো বটেই।