তাজপুর বন্দরে আদানি নেই, প্রকল্পের কী হবে?
২৩ নভেম্বর ২০২৩দু'দিনের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন শেষ হয়েছে বুধবার। এই মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করার জন্য ফের আন্তর্জাতিক দরপত্র জারি করা হবে।
তাজপুরে আদানি বিদায়
গতবারের বাণিজ্য সম্মেলনের পর থেকে তাজপুরের বন্দর নিয়ে প্রত্যাশা তুঙ্গে উঠেছিল। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প গোষ্ঠী আদানিদেরএই বন্দর তৈরি করার কথা ছিল। গত অক্টোবরে বন্দর গঠনের জন্য আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোনস সংস্থাকে 'লেটার অফ ইনটেন্ট' বা আগ্রহপত্র দিয়েছিল রাজ্য।
কিন্তু মঙ্গলবার বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হচ্ছে। সেটা ইতিমধ্যে প্রস্তুত। আপনারা চাইলে টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন। এই প্রকল্পে ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে।''
সাম্প্রতিক অতীতে এই সমুদ্র বন্দরকে রাজ্যের সবচেয়ে বড় শিল্প প্রকল্প হিসেবে ধরা হচ্ছিল। বন্দর নির্মাণে ১৫ হাজার কোটি ও এই সংক্রান্ত পরিকাঠামো তৈরিতে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ছিল। নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এটি চালুর লক্ষ্য রয়েছে। ১ লক্ষ ২৫ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশা রাজ্যের।
তাজপুরে সমুদ্রের ধারে ১২৫ একর জমির এই বন্দরের একটা প্রাথমিক রূপরেখাও তৈরি হয়েছিল। অনুসারী শিল্প গড়ার জন্য কিছুটা দূরে আরো হাজার একর জমি বন্দর নির্মাতাদের দেয়ার কথা ছিল। এজন্য জমি অধিগ্রহণেরও দরকার পড়েনি। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার হাজার একর জমি তৈরিই ছিল। কিন্তু নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে রাজ্য দরপত্র চাওয়ায় সবটাই বিশ বাঁও জলে।
বন্দর ঘিরে বাদানুবাদ
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই প্রস্তাবিত বন্দর। এতে রাজ্যে শিল্প উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে যেত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আপাতত এ সবে প্রশ্নচিহ্ন পড়ল কেন? নবান্ন বা আদানি গোষ্ঠীর কাছ থেকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এর ফলে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা, এবং শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বাদানুবাদ।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ''আদানিরা কখনো তাজপুরের প্রকল্প নিয়ে উৎসাহিত ছিল না। প্রায় এক দশক ধরে এই তাজপুর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রচার চালাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে এক বর্গ ইঞ্চির পরিকাঠামো তৈরি করা হয়নি।''
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ''তাজপুরে বন্দর হবে বলে রাজ্য জানিয়েছিল, আদানিদের প্রশংসা করেছিল। কিন্তু আজ অন্য কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দিতে হবে কেন? এর ব্যাখ্যা রাজ্যকেই দিতে হবে।''
তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনের প্রতিক্রিয়া, ''আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক মধুর। পশ্চিমবঙ্গে বড় প্রকল্প হোক, সেটা কি বিজেপি চায়? তাদের চাপেই আদানি গোষ্ঠী আগ্রহ হারাল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।''
মধুর সম্পর্কে ইতি?
রাজ্য ও আদানির সুসম্পর্ক নিয়ে নানা কথা শোনা গিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহাম্মদ সেলিম এমন দাবিও করেছেন, আদানিরা ইলেক্টোরাল বন্ডে তৃণমূলকে কোটি টাকা দিয়েছে! আদানিদের সঙ্গে রাজ্যের গাঁটছড়া ভাঙল কেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে। সম্প্রতি তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। যদিও গৌতম আদানিকে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায় রাজ্য। কিন্তু তারা সম্মেলনে যোগ দেননি।
তাজপুর-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের লাগোয়া এলাকার মানুষ সমুদ্র বন্দর নিয়ে আশায় বুক বাধছিলেন। ২০১৯ সালে বন্দরের জন্য একটি অস্থায়ী কার্যালয় খোলা হয়। গত বছর অক্টোবরে আদানি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এই কার্যালয়ে আসেন, প্রস্তাবিত এলাকা ঘুরে দেখেন। কিন্তু তারপর আদানিদের পক্ষ থেকে আর এলাকা পরিদর্শন করা হয়নি। তারা বন্দর গড়বে না, এটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় হতাশ স্থানীয় বাসিন্দারা।
হতাশার শেষ কোথায়
যদিও এতে হতাশার কিছু নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। তিনি বলেন, ''বিনিয়োগকারী হিসেবে আদানিরা খুব একটা ভালো নয়। ব্লুমবার্গ-এর তথ্য অনুযায়ী, আদানিদের ডেট ইকুইটি অনুপাত ২০:১ যেটা ভাবা যায় না। অর্থনীতির দৃষ্টিতে এটা তেমন ক্ষতি নয়। গ্লোবাল টেন্ডারে যদি ভাল কোনো সংস্থা বন্দর তৈরিতে এগিয়ে আসে, সেটা ইতিবাচক হবে।''
যদিও অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ী এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন। বিজেপি বিধায়ক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''এত বড় প্রকল্পে ডেট ইকুইটি অনুপাত বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এত হাজার কোটি টাকা নইলে কে বিনিয়োগ করবে? আদানিদের সার্টিফিকেট দেয়ার মত পর্যালোচনা আমি করিনি। তবে এই গোষ্ঠী সফল ভাবে ভারতে বন্দর তৈরি করেছে বিদেশ থেকে কন্ট্রাক্ট পেয়েছে।''
প্রকল্পের চুক্তি বা দরপত্র নিয়ে যে ধোঁয়াশা, সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠছে। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ প্রসেনজিৎ বসু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''সমুদ্র বন্দরের টেন্ডারের কী হলো, এর প্রজেক্ট রিপোর্ট বা কাগজপত্র কোথায়, এ সব গোপনে রাখা যায় না। কিংবা এবার যে গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হচ্ছে, তার নথিও বা কোথায়? সবটাই জনসমক্ষে আসা উচিত।''
অশোক লাহিড়ীর মন্তব্য, ''কোনো চুক্তি করার পর তা ভেঙে গেলে প্রশ্ন ওঠেই। যদি ভুল লোকের সঙ্গে চুক্তি করে থাকেন, তা হলে কেন করেছেন, আর যদি ঠিক লোকের সঙ্গে চুক্তি করে থাকেন, তাহলে সে চুক্তি ভাঙল কেন তা বলতে হবে।''