1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামলেন মমতা

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
১ সেপ্টেম্বর ২০২২

তার পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ দিলেন।

https://p.dw.com/p/4GIft
ভবানীপুর উপনির্বাচনে জেতার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভবানীপুর উপনির্বাচনে জেতার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: Mani Tewari Prabhakar

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, সিজারস ওয়াইফ মাস্ট বি অ্যাবাভ সাসপিশন। মোদ্দা কথা, যারা জনজীবনেআছেন তারা বেনিয়ম দেখলে তাদের আত্মীয়-স্বজন, এমনকী স্ত্রীকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করবেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের মানুষদের সম্পত্তিবৃদ্ধির অভিযোগ উঠলে তিনি যে প্রথমেই তার তদন্তের নির্দেশ দেবেন, সেটাই কাম্য।  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি ঠিক সেই কাজটাই করেছেন। মুখ্যসচিবকে বলেছেন, তদন্ত করে দেখতে।

আনন্দবাজারের রিপোর্ট বলছে, মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ''আমার জানা নেই, যদি আপনারা তদন্ত করে দেখেন এই ধরনের কোনো সরকারি জমি আমি নিয়েছি বা কাউকে পাইয়ে দিয়েছি, ইমিডিয়েটলি তদন্ত করে বুলডোজার দিয়ে উড়িয়ে দিন। আমার অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই।'' নিউজ১৮ জানাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী এই নির্দেশ দিয়েছেন পরিকাঠামো, শিল্প ও চাকরি সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন মাত্র।

সাধারণত, সরকার চলে লিখিত নির্দেশের ভিত্তিতে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মুখে কী বললেন, তার গুরুত্ব অতটা বেশি নয়। তবে আমরা ধরে নিলাম, মুখ্যমন্ত্রীরমৌখিক নির্দেশ শিরোধার্য করে মুখ্যসচিব তদন্ত করলেন। সেখানে কী তদন্ত করবেন? মুখ্যমন্ত্রী কোনো সরকারি জমি কম দামে পরিবারের কাউকে পাইয়ে দিয়েছেন কি না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিবিদ এই কাজ করবেন এটা কেউ মনে করেন বলে মনে হয় না। 

অভিযোগ হলো, তার পরিবারের মানুষের সম্পত্তিবৃদ্ধি নিয়ে। সেখানে একটা অভিযোগ, তারা বাজারদরের থেকে কম দামে বেশ কিছু সম্পত্তি কিনেছেন। অনেকে তাদের পেশা জানিয়েছেন, সমাজসেবা। সমাজসেবা করে সম্পত্তির মালিক হওয়া যায় কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তদন্ত তো সেই অভিযোগের হওয়া উচিত। আর এক্ষেত্রে মুখ্যসচিব বা তার অধস্তন অফিসাররা কী তদন্ত করবেন? তদন্ত করলে তার দায়িত্ব কোনো সাবেক বিচারপতির হাতে তুলে দেয়া উচিত ছিল।

কিন্তু মামলা যখন হাইকোর্টে তখন না হয় একটু অপেক্ষা করতেন মুখ্যমন্ত্রী। আদালত কী বলে তা দেখে সিদ্ধান্ত নিতেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথা, তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছেন।  এখানে অভিযোগ উঠেছে তার পরিবারের বিরুদ্ধে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পুরোটাই তার নিজের উপরে নিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আইনি নোটিস দেয়া হলে তিনি আইনি পথেই তার মোকাবিলা করবেন।

রিপোর্ট বলছে, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''আমার পরিবারকে নোটিস দিলে আমি আমার মতো লড়ব। যদিও এখন আইনত লড়া খুব কঠিন। এই জায়গাটাতেও বিজেপি-র হস্তক্ষেপ খুব বেশি হচ্ছে। এরপর তিনি বলেছেন, কোথাও না কোথাও এর বিচার হবে। অন্তত মানুষের আদালতে এর বিচার আমি পাব। আইনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে।''

এটা কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী! এ তো বিচারবিভাগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন তিনি। এই কথাও জানিয়ে দিলেন, আদালতে বিচার না পেলে তিনি মানুষের আদালতে বিচার পাবেন। অর্থাৎ, ভোটে জিতবেন। কোনো সন্দেহ নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনো রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তার নিরিখে তার আশেপাশে, সামনে পিছনে কেউ নেই। ভোটের ময়দানে জিতবেন এটা কোনো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, তার পরিবারের বিরুদ্ধে একটা মামলা নিয়ে তাকে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কেন দিতে হচ্ছে? তাহলে কি পার্থ-অর্পিতা, অনুব্রত কাণ্ডের পর মানুষের মনেও কিছু প্রশ্ন উঠছে? রাজ্যের মানুষের নাড়ি, তাদের চিন্তাভাবনা ও প্রতিক্রিয়ার কথাটা মমতা অসম্ভব ভালো বোঝেন। বর্তমান রাজনীতিকদের মধ্যে এই ক্ষেত্রে তার সমকক্ষ কেউ নেই। তাহলে কি একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ রীতিমতো চিন্তায় ফেলেছে মুখ্যমন্ত্রীকে এবং যখন সেটা তার পরিবারের বিরুদ্ধে উঠেছে, তখন আগে থেকেই ড্যামেজ কন্ট্রোলের পথে হাঁটতে হচ্ছে তাকে।

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে।
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে। ছবি: privat

মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের মানুষদের সম্পত্তি বৃদ্ধির অভিযোগ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করেছেন বিজেপি-র আইনজীবী সেলের সঙ্গে যুক্ত এক আইনজীবী। আদালত সচরাচর যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা হলো, মামলা গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আগে নোটিস দেয়া হয়। সেই নোটিসের জবাব দেয়া মানে এই অভিযোগ নিয়ে নিজেদের বক্তব্য আদালতকে জানানো। সেই নোটিসের বিষয়টাকেই বা এতটা বড় করে দেখছেন কেন মমতা?

সম্ভবত তিনি দিগন্তে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের খুব বেশি দেরি নেই। ২০১৯-এ রাজ্য থেকে ১৮টি আসন জিতেছিল নরেন্দ্র মোদীর দল। তারা সেই আসনগুলি বজায় রাখতে চাইবে, পারলে বাড়াতে চাইবে। আর তার জন্য মোদীর হাতিয়ার হবে তৃণমূলের দুর্নীতি। পার্থ-অর্পিতা, অনুব্রত তো আছেই, সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ইডি ও সিবিআই তদন্ত করছে। এবার মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্পত্তি নিয়ে যদি মামলা চলতে তাকে, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। দুর্নীতির অভিযোগ যদি মানুষের মনে গেঁথে যায়, তাহলে কী হতে পারে, তার উদাহরণ হলো বফর্স এবং ২০১৯-এ ইউপিএ ২-এর বিরুদ্ধে একের পর এক কেলেঙ্কারির জেরে মানুষের শাস্তি দেয়া।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম ইউএসপি এবং তার রাজনৈতিক জোর হলো, তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। টালিগঞ্জের টালির ঘরে থাকা, হাওয়াই চটি পরা বিলাসিতা বর্জিত জীবন, যিনি পার্লামেন্টে রেলমন্ত্রী থাকার সময় এককাপ চা খেলেও পয়সা দিয়ে দিতেন। তার ঘরে অতিথিদের চায়ের পয়সাও মিটিয়ে দিতেন কড়ায়-গণ্ডায়। কোনোদিন দিল্লিতে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেননি। বিমানে বিজনেস ক্লাসে চড়েননি। সেই মমতার ঘরের মানুষদের বিপক্ষে যদি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয়।

ভোটে লড়ার সময়, মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সব কেন্দ্রেই আসলে তিনিই প্রার্থী। তাকে দেখেই যেন ভোট দেন মানুষ। পরিবারের ক্ষেত্রেও একই নীতি নিয়ে চলছেন তিনি। কিন্তু ওই সিজারস ওয়াইফের আপ্তবাক্য মেনে তাহলে ব্যবস্থা নিতে হয় তাকে। কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তিনি এখানে অভিযোগটা নিজের দিকেই নিয়ে নিয়েছেন। ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গিয়ে কি বড় বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন মুখ্যমন্ত্রী?