1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ট্রল দিয়ে যায় চেনা

গৌতম হোড়
২৯ অক্টোবর ২০২১

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে গোহারা হারার পরেই শুরু হয়ে গেল ট্রলিং৷ মহম্মদ শামির বিরুদ্ধে৷ কেন?

https://p.dw.com/p/42LqD
Cricket Bildkombo l Virat Kohli, Indien vs Babar Azam, Pakistan

ভারতীয় দলের ১১ জনের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করা হলো মাত্র একজনকে৷ মহম্মদ শামি৷ রোহিত শর্মা, কে এল রাহুল, বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমার, রবীন্দ্র জাদেজা, সূর্যকুমার যাদবেরা নয়, শুধু শামির প্রতি বর্ষিত হতে লাগলো ঘৃণার ক্লেদ৷ দেয়া হতে থাকল, তাকে পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ৷ কেন? কারণটা খুবই সহজ৷ ১১ জনের মধ্যে শামিই একমাত্র মুসলিম৷ আর ভারতে কট্টরপন্থি মনোভাবের ধারক-বাহকরা মাঝেমধ্যেই এই ধরনের পরামর্শ দিতে অভ্যস্ত৷ এর আগে নেতা-সাংসদরাও অনেকবার মুসলিমদের উদ্দেশ্যে এই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন৷ ভারতে থাকতে না পারলে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ৷ যেন এটা তাদের দেশ নয়, যেন এই জন্মভূমিকে তারা অস্বীকার করেন, যেন ভারত নামক এই বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণের দেশের সঙ্গে তারা একাত্মতা বোধ করেন না!

এ এক অদ্ভুত কট্টরপন্থা৷ যার মধ্যে কোনো যুক্তি নেই, বোধ নেই, চিন্তাভাবনার কোনো লেশ নেই, আছে শুধু এক বিভাজনের প্রয়াস, এক ঘৃণার আবহ, যা দীর্ঘদিনের সযত্নলালিত বিশ্বাসের, পরিবেশের মূলে আঘাত দেয়৷ সস্তা, খুবই সস্তা রুচিহীন মনোভাব প্রকাশ করে৷ নিজের দেশের একাংশের প্রতি এই অবিশ্বাস অনেক বড় সংকট ডেকে আনে৷ কিন্তু এখন সময়ই হলো অবিশ্বাসের, অসহিষ্ণুতার, আঘাত করার৷ বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতা৷ মানুষ আর যুক্তি দিয়ে কিছু ভাবে না৷ তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দেয় সংকীর্ণ ভাবনা৷ আর অনেকসময়ই আশু লাভের কথা ভেবে তাকে আরো উসকে দেন রাজনীতিবিদরা৷ তারা আগুন নেভানোর বদলে তাকে আরো বাড়িয়ে দেন৷ ভোট পাওয়ার মরিয়া তাগিদে তারা নষ্ট করে দিতে থাকেন সম্প্রীতির পরিবেশ৷ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে, কার্টুন আঁকলে জেলে যেতে হয়৷ কিন্তু শামিদের বিরুদ্ধে এহেন বিষোদ্গার করলে কাউকে শাস্তি পেতে হয় না৷ কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না৷ ফলে কুৎসা বাড়তে থাকে৷

শামি এর একটা উদাহরণ৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত খুবই বাজে খেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ বিরাট কোহলি ও কিছুটা ঋষভ পন্থ ছাড়া ব্যাটিংয়ে কেউ সফল নন৷ বোলারদের কথা আর না বলাই ভালো৷ বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমার, বরুণ চক্রবর্তী, শামি, রবীন্দ্র জাদেজারা কেউ একটা উইকেটও পাননি৷ পাকিস্তান দশ উইকেটে জিতেছে৷ স্মরণকালের মধ্যে এরকম ঘটনা হয়নি৷ তাতে ক্রিকেটপ্রেমীদের খারাপ লাগতে পারে৷ কিন্তু তাই বলে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় মানুষজনের একাংশ একজনকে বেছে নেবেন? এখানেও ঢুকে যাবে ধর্মীয় বিভেদ? কাঠগড়ায় তুলতে হলে পুরো ভারতীয় ক্রিকেট দলকে তোলা উচিত৷ যদিও সেটাও অন্যায়৷ কারণ, খেলায় হার-জিত আছে৷ এর আগে ভারত ৪২ রানে অলআউট হয়েছে৷ অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে টেস্টে শোচনীয়ভাবে হেরেছে৷ তারপরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে৷

শচিন টেন্ডুলকরও তো শূন্যে আউট হয়েছেন, ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা জন ব্র্যাডম্যান তো শেষ ইনিংসে চার রান করতে পারেননি৷ করলে তার ব্যাটিং গড় হতো ১০০৷ সেই একটা ব্যর্থতা দিয়ে কি তার বিচার হবে? নাকি বিচার হবে তার সারা জীবনের ক্রিকেট ইনিংসের বিচারে৷ শামি যখন ভালো বল করে জেতান, তখন?

স্বস্তির কথা একটাই, সকলেই এই হাওয়ায় ভাসেননি৷ এই সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে শামিকে সমর্থন করেছেন অসংখ্য মানুষ৷ করেছে ভারতীয় বোর্ড৷ করেছেন শচিন, শেহবাগ, লক্ষ্মণ, হরভজন, চাহাল-সহ অসংখ্য ক্রিকেটার৷ করেছেন, রাহুল গান্ধী, প্রীতি জিন্টা সহ ক্রিকেট মাঠের বাইরে থাকা মানুষ৷ শামির পাশে থাকার বার্তা নিয়ে অসংখ্য টুইট হয়েছে৷ মূল্যবোধের অবক্ষয় হতে পারে, কিন্তু তার মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মানুষেরও অভাব নেই৷

এ তো গেল শামির প্রসঙ্গ৷ এখন ট্রোল করার জন্য কোনো কারণের দরকার হয় না৷ এই তো অলিম্পিকে টেনিসের ডাবলসে প্রথম রাউন্ডে হেরে গেছিলেন সানিয়া মির্জা৷ তারপর তিনি সামাজিক মাধ্যমে নিজের কয়েকটি ছবি দিয়েছিলেন৷ তারপরই শুরু হলো তাকে ট্রোল করা৷ প্রশ্ন করা হলো, টেনিসে তো জিততে পারেন না, এখন এই সব সেজেগুজে ছবি দেয়া ছাড়া আর কী করবেন সানিয়া? কারা এই সব প্লেয়ারদের বাছে? যেন একজন খেলোয়াড়ের কোনো ব্যক্তিগত জীবন থাকতে নেই৷ যেন সেজেগুজে ছবি পোস্ট করা ফিল্মের তারকা ওবং আম-জনতার অধিকার, খেলোয়াড় বা অন্য পেশার ব্যক্তিত্বদের সেই অধিকার নেই৷ যেন, শিক্ষকরা পড়ানো ছাড়া অন্য দিকে তাকাবেন না, ছাত্রছাত্রীরা বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকবে, ক্রীড়াবিদেরা একবার ব্যর্থ হলে লজ্জায় মুখ দেখাবেন না৷

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

খারাপ উদাহরণের তো অভাব নেই৷ বিরাট কোহলি ব্যর্থ হলে তাকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে অবধারিতভাবে এসে পড়বে আনুশকা শর্মার নাম৷ যেন কোহলি মানেই অনুস্কা৷ দুজনের জগত এক৷ তাদের ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না৷ ব্যক্তিস্বাধীনতা বিষয়টা উপমহাদেশে মরীচিকার মতো৷ তাই কোহলি ব্যর্থ হলে টেনে আনা হয় অনুশকাকে৷ পতির পূণ্যে যদি স্ত্রীর পূণ্য হয় তাহলে, পতির দোষে স্ত্রীও ভাগিদার হবে৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তো সেই কবে লিখে গিয়েছিলেন, কী বিচিত্র এই দেশ৷ পুরুষতান্ত্রিক এই উপমহাদেশের সবকিছুই আবর্তিত হয় পুরুষকে কেন্দ্র করে৷ নারীর আলাদা পরিচয়েরই দরকার নেই৷ অনুশকা অত্যন্ত ভালো অভিনেত্রী৷ কিন্তু ক্রিকেট মাঠে বিরাটের সাফল্য-ব্যর্থতার দায় কেন তার?

সামাজিক মাধ্যম সাধারণ মানুষকে মন খোলার, নিজের মত জানানোর সুযোগ করে দিয়েছে৷ এটা জরুরি, খুবই জরুরি৷ কিন্তু এই সুযোগে তৈরি হচ্ছে, যুক্তিহীন, বোধহীন কিছু মানুষের অসহ্য রণহুঙ্কার৷ যারা শুধু চিৎকার করে, অশালীন মন্তব্য করে, কট্টরপন্থার আশ্রয় নিয়ে কুৎসা করতে দক্ষ৷ আর কিছু বোধহীন মানুষ তা চেটেপুটে খাচ্ছে৷ উপমহাদেশজুড়ে এই মানুষদের তাণ্ডবে মাঝেমধ্যেই জীবনানন্দের বোধ কবিতাটা মনে পড়ে৷ ‘‘হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়; আমি তারে পারি না এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়-পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়, শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়৷''

তারপর মনে হয়, এটাই তো সব নয়৷ শামির বিষয়টিই দেখুন৷ যারা ট্রোল করছিল, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে তাদের স্বর চাপা পড়ে গেছে৷ অধিকাংশ মানুষই তো শামির পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ ভারতীয় ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ খেলার মাঠের হারজিতকে জীবনের ময়দানের হারজিতে পরিণত করেননি৷ তাই শূন্যতা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠি৷ সাময়িক অন্ধকারের শেষে আলো আসে৷