টিআইবির অভিযোগ: কী করবে নির্বাচন কমিশন?
১৬ জানুয়ারি ২০১৯ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২৯৯টি আসনের মধ্যে ৫০টি আসন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে৷ দৈব চয়নের ভিত্তিতে ওই ৫০টি আসন বাছাই করে তারা৷ তারই প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপন করেছে মঙ্গলবার৷ ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া' শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে টিআইবি বলছে, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো- না-কোনো ধরনের অনিময়ম পাওয়া গেছে৷ এর মধ্যে গুরুতর অনিয়মগুলো হলো:
১. ভোটের আগের রাতে ৩৩টি আসনে ব্যালট পেপারে সিল মারা
২. জাল ভোট ৪১টি আসনে
৩. ভোট শুরুর আগেই ব্যালটবাক্স ভরে রাখা হয়েছে ২০টি আসনে
৪. বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল ৩০টি আসনে
৫. আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব ভূমিকা ৪২ আসনে
৬. ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা ভোটদানে বাধা ২১ টি আসনে
৭. নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে ২৬টি আসনে
৮. ব্যালট পেপার আগেই শেষ হয়ে যায় ২২টি আসনে
৯. প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে ঢুকতে দেয়া হয়নি ২৯টি আসনে৷
টিআইবি ২৯৯ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি আসনে গবেষণার যে তথ্য দিয়েছে, তাতে গড়ে ৯৪ শতাংশ আসনে নির্বাচনি অনিয়ম হয়েছে৷ জাল ভোট পড়েছে ৮২ শতাংশ আসনে৷ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটবাক্সে সিল মারা হয়েছে ৬৬ শতাংশ আসনে৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন বৈধ, না অবৈধ সেটা নিয়ে আমরা কোনো গবেষণা করিনি৷ আমরা নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছি৷ আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে নির্বাচনের এই ধারা কোনোভাবেই অব্যাহত থাকতে পারে না৷ এটা অব্যাহত থাকলে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র সুদূর পরাহত হয়ে উঠবে৷ এ কারণেই আমরা কিছু সুপারিশ করেছি৷ আশা করছি সেগুলো বিবেচনায় নেয়া হবে৷''
টিআইবি যে ধরনের নির্বাচনপ্রক্রিয়ার চিত্র তুলে এনেছে, তার মাধ্যমে গঠিত একটি সরকার চলতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সেটা আমরা বলতে পারব না৷ এ নিয়ে আমাদের মন্তব্য করাও ঠিক হবে না৷ বিরোধীপক্ষ আইনি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতে পারে৷ তাদের কেউ কেউ আদালতে যাওয়ারও কথা বলেছে৷ নির্বাচন কমিশন দেখতে পারে৷ এটা আমাদের এখতিয়ারবহির্ভূত৷''
এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম টিআইবির এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যা করেছেন৷ তিনি মঙ্গলবারই সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘প্রতিবেদনটি পূর্বনির্ধারিত ও মনগড়া৷ এটা কোনো গবেষণা নয়৷ গবেষণায় যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তা এখানে প্রয়োগ করা হয়নি৷ এই প্রতিবেদন আমাদের দেয়া হয়নি৷ এটা আমরা আমলেও নিচ্ছি না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘টিআইবি বাছাই করা প্রার্থীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে৷ জামায়াতের প্রার্থীদের কাছ থেকে তথ্য নিলে গবেষণা প্রতিবেদন একরকম হবে আর আওয়ামীলীগের প্রার্থীদের কাছ নিলে তা আরেক রকম হবে৷ এই গবেষণায় টিআইবির বাছাই করা প্রার্থী কারা, সেটা স্পষ্ট নয়৷''
আর বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘টিআইবি'র অভিযোগ অলীক রহস্যময় কাহিনি৷ টিআইবিকে বলবো ‘গল্প খাওয়াচ্ছেন, অনেক অবিশ্বাস্য রূপকথার কাহিনি সাজাচ্ছেন- নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি৷ স্বচ্ছ ব্যালটবক্স ব্যবহার করা হয়েছে৷ আপনাদের কোনো একজন প্রতিনিধি বা প্রতিপক্ষের এজেন্ট নির্বাচনি কেন্দ্রে কি এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা চ্যালেঞ্জ করেছে?' টিআইবি আসলে স্বচ্ছতার বিরুদ্ধে কথা বলছে৷''
এর জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনার যা বলেছেন, তা তাঁর মন্তব্য৷ তাঁর অবস্থান৷ কিন্তু টিআআইবি'র গবেষণাপদ্ধতি নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলেন, তাহলে বলবো, টিআইবি কোনো ভিত্তিহীন বা নিয়মনীতিহীন গবেষণা করে না৷ গবেষণায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অবলম্বন করে৷ টিআইবি'র গবেষণার আন্তর্জাতিকমান স্বীকৃত৷ আর আমরা এরই মধ্যে আমাদের গবেষণা নির্বাচন কমিশনকে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ তাঁরা তা দেখতে পারেন৷''
টিআইবি'র এই গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তার প্রেক্ষিতে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিআইবি'র এই প্রতিবেদনকে ‘ভুয়া' বা ‘পূর্ব নির্ধারিত' না বলে নির্বাচন কমিশনের এখন উচিত হবে এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে তদন্ত করা৷ তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া৷ এ নিয়ে আগে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের উদাহরণ আছে৷ একটা বিখ্যাত মামলা আছে৷ নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম৷ এই মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে যে, যদি কোনো নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ বা প্রশ্ন ওঠে, তাহলে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে৷ তাদের নির্বাচন বাতিল করারও ক্ষমতা আছে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে মানুষের ভোটাধিকারই প্রশ্নবিদ্ধ৷ তাই নির্বাচন কমিশনকে সবার আগে তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে৷ তারপর অন্য ব্যবস্থা৷''