শিক্ষকের সততা
৭ জুন ২০১২এ তো শুধু নিজের মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির কথা বললাম৷ কিন্তু জার্মান জাতি তাদের নিজেদের ভাষাকে যে কতোটা ভালোবাসে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন৷ আমাদের জনদরদী রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে শিক্ষিত পেশাজীবীরা বাংলার সাথে ইংরেজি জুড়ে দেওয়া ছাড়া তো একটি বাক্যও গঠন করতে পারবেন কি না সন্দেহ রয়েছে৷ অথচ জার্মান জাতির সেই শীর্ষ ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে ভবঘুরে পর্যন্ত সবার কাছে প্রথম এবং প্রধান মূল্যবোধ হলো একেবারে খাঁটি জার্মান ভাষায় কথা বলতে হবে৷ আর সেই জার্মান ভাষার সাথে একটু-আধটুও বিদেশি ভাষা যোগ করা চলবে না, জার্মান ভাষাবিদদের ঐকমত্যে স্বীকৃত শব্দ ছাড়া৷ তবে সম্প্রতি জার্মান ভাষাতেও কিছুটা বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ আর তা নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে৷
যাহোক, ইংরেজি, ফরাসি কিংবা স্পেনীয় ভাষা কেউ জানলো কি না তাতে জার্মানদের কিছুই আসে যায় না৷ তবে মাতৃভাষাকে পুরোপুরি বক্ষে ধারণ করে, লালন করে তারপর আরো দুয়েকটি ভাষা শেখার চেষ্টা তাদের অনেকেরই রয়েছে৷
ভাষা নিয়ে এতো কথা বলার পেছনে আসলে অন্য কারণ রয়েছে৷ সেটি হলো, মাতৃভাষার প্রতি এতোটা ভক্তি থেকেই বুঝি ব্যাপারটা এখন এতোদূর গড়িয়েছে যে, জার্মানিতে কেউ বাস করতে আসবে আর জার্মান ভাষা জানবে না তা যেন হতেই পারে না৷ বাজার-ঘাট, পথ-প্রান্তর, দপ্তর-আদালত সব জায়গায়, বলতে গেলে, একমাত্র মাধ্যম জার্মান ভাষা৷ এমনকি দীর্ঘ দীর্ঘ দলিল, চুক্তিনামা কিংবা বিভিন্ন আবেদন পত্র সবই জার্মান ভাষায়৷ এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ দুয়েকটির হয়তো অন্য ভাষায় অনুবাদ জুটতে পারে বহু কষ্টে৷ ফলে একটু দীর্ঘ সময় জার্মানিতে থাকতে হলে কারো ভাষা না শিখে উপায় নেই৷ তাই তাদের ভাষা শেখার বিদ্যালয় কিংবা বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে প্রায় সর্বত্রই৷
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জার্মানির প্রতিনিধিত্বকারী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ডয়চে ভেলেতে অর্ধ শতাধিক দেশের মানুষের সমাগম৷ তাই সেখানেও চালু আছে বিনা পয়সায় জার্মান ভাষা শিক্ষার একাধিক কোর্স৷ এছাড়া ডয়চে ভেলের পাশেই রয়েছে সুউচ্চ দু'টি ভবনে জাতিসংঘ এবং জার্মান ডাক সংস্থার কার্যালয়৷ তাই এই এলাকায় বিদেশি মানুষের আনাগোনা একটু বেশিই৷ তাই এখানেই রয়েছে আরো একটি বেসরকারি ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠান৷ ফলে জার্মানিতে এসেই প্রথম মাস থেকেই জার্মান ভাষা শেখার প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে জুড়ে নিতে হয়েছে৷ ফলে ইতিমধ্যে জার্মানির সাধারণ মানুষের মধ্যে তো বটেই শিক্ষকদের মাঝেও যে সততা চোখে পড়েছে তা অভাবনীয়৷
জার্মানদের সময়জ্ঞানের এমনিতেই বিশেষ খ্যাতি রয়েছে৷ কিন্তু মহান পেশায় জড়িত শিক্ষকদের সময়জ্ঞান ও সতর্কতার মাত্রাটা বোধ হয় আরো এক ধাপ উপরে৷ কোন শিক্ষককেই কখনও এক মিনিট পরে আসতে দেখা যায় না৷ বরং পাঁচ-দশ মিনিট আগে এসে তাঁরা পড়ানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন৷
এরকমই মহান এবং খুবই দক্ষ একজন শিক্ষকের একটি ঘটনা আমাদের প্রচণ্ড আলোড়িত করে৷ ডয়চে ভেলেতে আমাদের একেকটি ভাষা শেখার কোর্স চলে দিনে দেড় ঘণ্টা করে৷ আমাদের সেই মহান শিক্ষক সপ্তাহে একদিন পড়াতেন৷ কোন এক জরুরি প্রয়োজনে একদিন জানালেন সেদিন তিনি আমাদের এক ঘণ্টা পড়াবেন৷ আমরাও খুশি যে, ভালই হলো একটু আগেই ছুটি পেলাম আজ৷ পরের সপ্তাহেও তিনি জানালেন, সেদিনও এক ঘণ্টা পড়াবেন৷ কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহে এসেও তিনি একইকথা বললেন৷ আমরা একটু আশ্চর্য হলাম যে, তিনি কি ফাঁকি দেওয়া শুরু করলেন? কিন্তু না৷ তিনি নিজেই তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য খুলে বললেন আসল হিসাব৷
তাঁর যুক্তি হচ্ছে, তিনি একদিন জরুরি প্রয়োজনে আধা ঘণ্টা কম পড়িয়েছেন৷ তাই তিনি তিন দিনই আধা ঘণ্টা করে কম পড়িয়ে তিন দিনে মোট তিন ঘণ্টা পড়িয়েছেন৷ যাতে করে এই তিন ঘণ্টার জন্য তিনি দেড় ঘণ্টা করে দুই দিন পড়ানোর সম্মানি ডয়চে ভেলের কাছ থেকে নিতে পারেন৷ অর্থাৎ তিনি তিন দিনই পড়িয়েছেন কিন্তু টাকা নিবেন দুই দিনের৷ কারণ তিন দিনে তিনি মোট দেড় ঘণ্টা অর্থাৎ একদিনের পড়া কম পড়িয়েছেন৷ তাঁর এই হিসাব শুনে আমরা তো সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লাম৷ আর তখনই বুঝলাম, কী করে এই জাতির পক্ষে এতো অল্প সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী দেশে এবং একটি সভ্য ও উন্নত দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছে৷ তখনই বুঝলাম, সত্যিই একজন শিক্ষক কতোটা মহান হতে পারেন, যদি তাঁর মধ্যে সততা থাকে৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন