‘ডুয়াল সিস্টেম’
৯ এপ্রিল ২০১২তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয়
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থার এমন একটি বিশেষত্ব রয়েছে, যা গোটা বিশ্বেই সমাদর পেয়ে থাকে৷ শুধু পুঁথিপড়া বিদ্যা নয়, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের বিষয়টিকেও শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোয় অন্তর্গত করা হয়৷ তাছাড়া সব স্কুল পড়ুয়াই যে শেষ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তারও কোনো প্রয়োজন নেই৷ নবম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে পড়া বাধ্যতামূলক৷ তারপর সরাসরি কোনো পেশার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে৷ বাকিরা ১২ বা ১৩ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে৷ এরাও ইচ্ছা করলে পেশাগত শিক্ষা নিতে পারে এবং সেই শিক্ষা হাতেনাতে কাজে লাগাতে কোনো সংস্থায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে৷ এই ‘ডুয়াল সিস্টেম'এর ফলে দুই থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তরুণ-তরুণীরা প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা – দুটোই অর্জন করতে পারে৷
জার্মানিতে আসলে পেশাগত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের একটা ঐতিহ্য রয়েছে৷ সেই মধ্যযুগেই ‘গিল্ড' বা সংঘের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো৷ ১৮৬৯ সাল থেকেই ১৮ বছরের কম বয়সী শ্রমিকদের জন্য জার্মানিতে পেশাগত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক৷ আজ ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী স্কুল-পড়ুয়ারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যে তারা কোনো বিশেষ পেশার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে চায় কি না৷ তখন তারা সাধারণ স্কুল ছেড়ে ছুতোর মিস্ত্রি, পাচক, নার্স বা ব্যাংকের কেরানি হবার প্রশিক্ষণ শুরু করতে পারে৷
বিশাল অবকাঠামো
জার্মানিতে প্রায় ৩৫০টি পেশার জন্য এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে৷ এর ফলে কিশোর-কিশোরীরা যথেষ্ট সময় নিয়ে এই ধরনের পেশা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পেতে পারে৷ লাভ হয় সেই সব কারখানা বা সংস্থারও, যাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে৷ শিক্ষানবিশ হিসেবে কিশোর-কিশোরীরা যে জ্ঞান অর্জন করে, তা শেষ পর্যন্ত এই সব সংস্থারই কাজে লাগে৷ যারা ভালো প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের হাতছাড়া না করে অবিলম্বে নিয়োগ করা হয়ে থাকে৷ উল্লেখ্য, জার্মানিতে পারদর্শী শ্রমিক ও কর্মীর চাহিদা বেড়েই চলেছে৷
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ের হিসেব অনুযায়ী জার্মানিতে প্রায় ১৬ লক্ষ কিশোর-কিশোরী এই ‘ডুয়াল সিস্টেম'এর আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে৷ তা সত্ত্বেও অবশ্য স্কুল থেকে বেরিয়ে অনেকে প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় নি৷ এর অন্যতম কারণ হলো, গত কয়েক বছরে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার মানদণ্ড বেড়েই চলেছে৷ যেমন গাড়ি মেরামত করতে হলে আজকাল ইলেকট্রনিক সম্পর্কেও জ্ঞান থাকতে হয়৷ তার জন্য আবার চাই ভালো অঙ্কের মাথা৷ ফলে বেশিরভাগ কোম্পানি সম্ভব হলে সেই সব স্কুল-পড়ুয়াদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে চায়, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উপযুক্ত৷ ২০১০ সালে প্রায় ৮৪,০০০ কিশোর-কিশোরী প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় নি৷
চাই উচ্চ মান
শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কোম্পানিতে হাতেনাতে কাজ শেখার সুযোগের যে অবকাঠামো আছে, তা বেশ উন্নত৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সবাই সব সময়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না৷ কারণ প্রার্থীদের প্রায়ই কোনো না কোনো যোগ্যতার অভাব দেখা যায়৷ যেমন স্কুলের পাঠ ঠিকমতো শেষ না করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না৷ সেক্ষেত্রে পরবর্তী ধাপে পদে পদে বাধা উঠে আসে৷ এটাকেই ভবিষ্যতে পেশা জীবনের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়৷
কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া কি সত্যি কঠিন? বিশেষ করে জার্মানির মতো শিল্পোন্নত দেশে, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক? কাগজে-কলমে সবাই কমপক্ষে নবম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে গেলেও সবাই যে ঠিকমতো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, তা নয়৷ বিশেষ করে বিদেশি বংশোদ্ভূত পড়ুয়াদের প্রায়ই বেশ সমস্যায় পড়তে হয়৷ এদের অনেকেরই বাড়িতে জার্মান ভাষার চর্চা হয় একেবারে নেই, অথবা তার মান যথেষ্ট নয়৷ শুধু ভাষার দুর্বলতার কারণেই ক্লাসে বাকি পড়ুয়াদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে এরা৷ পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ হয় না৷ প্রশিক্ষণের সুযোগও তাই কঠিন হয়ে পড়ে৷ দুর্বলতা কাটাতে হলে বাড়তি পদক্ষেপ নিতে হয় এদের৷ কর্মসংস্থান দপ্তর ও কিছু সংস্থা এই বাড়তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়৷ যারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে, তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল৷ কারণ সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারলে পারদর্শী কর্মীর চাহিদা পূরণ করতে পারে প্রার্থীরা৷
যোগ্যতার চাহিদা
জার্মানির অনেক সংস্থায় উপযুক্ত কর্মীর এতই চাহিদা, যে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারা বেশ নমনীয়তা দেখায়৷ তাদের অতীতের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা৷ এমনকি বিদেশি প্রার্থীও যদি বিশেষ দক্ষতা দেখাতে পারে, তাহলে তাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়৷ অনেকের ক্ষমতা যাচাই করে দেখতে প্রথমে তাদের শিক্ষানবিশ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়৷ তারপরই কাজ পাকা হতে পারে৷
জার্মানির এই ‘ডুয়াল সিস্টেম' অনুকরণ করতে চায় অনেক দেশ৷ তবে সব ক্ষেত্রে তা সফল হয় না৷ উচ্চ মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তবেই ‘ভালো' প্রার্থীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করার আগ্রহ দেখায়৷ শুধু দুর্বল স্কুল পড়ুয়া বা ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে এমন ব্যবস্থা চালু করলে তা কারো কাজে লাগে না৷ তাছাড়া এই ব্যবস্থার কাঠামোর সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত থাকতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে৷ সমন্বয়ের অভাব না থাকলে এই ব্যবস্থাকে সফল করা কঠিন৷
প্রতিবেদন: ব্রিটা ম্যার্শ / সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আরাফাতুল ইসলাম