জার্মানিতে পারিবারিক নীতিমালা
৮ জুলাই ২০১৩সামাজিক চিত্রটা অনেক বদলেছে
গত কয়েক বছরে জার্মানির সামাজিক চিত্রটা অনেক বদলেছে৷ মা-বাবা পেশা ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছেন৷ এদিক দিয়ে জার্মানি অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে৷ জন্মহার কমে যাচ্ছে৷ মেয়েরা চাকরির বাজারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ কর্মক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখা যায় না৷ এক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকেও কার্যকরী সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না ৷
ইসাবেল গ্রোনাক ভালৎস প্রথম সন্তান জন্মের কয়েক মাস পর তাঁর স্বামীর সঙ্গে মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন৷ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকায় নিজের ইচ্ছামতো সময় ভাগ করে নিতে পারেন তিনি৷ যেমন, টিন এজের দুই মেয়ে দুপুরের পর জুডো ও বেহালা শিখতে গেলে বাবা-মা কাজ করেন তখন৷ পাঁচটার সময় ছোট ছেলে ইউলিসকে ‘ডে স্কুল' থেকে নিয়ে আসা হয়৷ তারপর রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া হয়৷ ইউলিসকে বই পড়ে শোনাতে হয়৷ এইভাবেই দিনটি শেষ হয়ে যায়৷
জার্মানিতে জন্মহার অনেক কম
তিন সন্তানের পরিবার জার্মানিতে খুব কমই দেখা যায়৷ নারী-পুরুষ বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে দু'বার চিন্তা করেন৷ জার্মানিতে এখন একজন নারী গড়ে ১.৩৬ বাচ্চার জন্ম দেন৷ ইউরোপের অন্য কোনো দেশে এত কম বাচ্চার জন্ম হয় না৷ রাজনীতিকরা এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং পরিস্থিতির পরিবর্তনে সচেষ্ট হচ্ছেন৷ কিন্তু বাচ্চাদের দেখাশোনা ও মেয়েদের পেশাজগতে ফিরে আসার ব্যাপারে একমত হতে পারছেন না৷ এমনকি একই রাজনৈতিক দলের ভেতরে রয়েছে মতানৈক্য৷
ঠিক একই ভাবে সরকারের তরফ থেকে পরিবারের জন্যে যে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে জানানো হচ্ছে, তাতেও পরস্পর বিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা যায়৷ একদিকে সন্তানের লালন-পালনের জন্য ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ যাতে মায়েরা পুরোপুরি সংসার ও সন্তানের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন৷ চাকরি ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হন৷ অন্যদিকে, সন্তান জন্মানোর আগে বা পরে শুধু মা নন, বাবাও যাতে ছুটি নিতে পারনে, তার জন্য ‘পেরেন্টাল লিভ'-এর প্রবর্তন করা হয়েছে৷ যাতে কর্মজীবী মায়েদের পক্ষে ক্যারিয়ার সত্ত্বেও সন্তান লালন-পালন করা সহজ হয়৷
পেশা ও ক্যারিয়ারে সমন্বয় সহজ নয়
‘‘আমি বুঝতে পারি, মেয়েরা কেন বাচ্চা না নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান৷ কেননা এই দুইয়ের মাঝে সমন্বয় করা সহজ নয়৷ আমি মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনা করেছি৷ কিন্তু তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ক্যারিয়ার গড়তে গেলে বাচ্চা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ পেশা ও পরিবার এই দুটির কোনোটাই ঠিকমতো উপভোগ করতে পারবো না'', বলেন ইসাবেল গ্রোনাক ভালৎস৷
পেশাজীবী মায়েদের এক সংঘের প্রধান কর্নেলিয়া শ্পাখটহলৎস এই প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানিয়ে বলেন, সন্তানকে ক্যারিয়ারের প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করা হয়৷ ‘‘আমাদের দেশে বাচ্চাদের স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি৷'' ছেলে-মেয়েদের বড় করার দায়িত্ব শুধু মা-বাবার নয়, গোটা সমাজের৷ কিন্তু কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিতে লক্ষ্য করা যায় একই পদের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি যোগ্য নারী প্রার্থী থাকলেও পুরুষ প্রার্থীকেই নিয়োগ দেওয়া হয়৷ কেননা বাচ্চা হলে মেয়েরা ছুটি নিতে পারে এই চিন্তাটা নিয়োগদাতাদের মাথায় থাকে৷ বাস্তবিকই ‘পেরেন্টাল লিভ' মা-বাবা দু'জনের জন্য প্রযোজ্য হলেও সাধারণত মায়েরাই সন্তান জন্মের পর ছুটি নিয়ে থাকেন৷
ফ্রান্স ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া এগিয়ে আছে
ফ্রান্স ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নানা রকম মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে, যা পরিবারকে কিছুটা চাপমুক্ত করতে পারে৷ জার্মানিতেও এই সব অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে৷ কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখা যায়৷
‘‘ফ্রান্সে এটা খুবই স্বাভাবিক যে মায়েরা চাকরি করতে যান৷ সমাজের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না৷ ‘খারাপ মা' বলে কথা শুনতে হয় না তাদের৷ ফরাসিরা তো আমাদের জার্মানদের নিয়ে হাসে৷ কেননা এখানে বিশ্বাস করা হয় যে, মায়ের চেয়ে আর কেউ ভালোভাবে বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারে না৷ ‘‘আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর চাপ সৃষ্টি করি৷ সব কিছু ভালোভাবে না পারলে নার্ভাস হয়ে পড়ি৷ পরিবার ও পেশা একসাথে চলতে পারে কিনা, এ নিয়ে চিন্তায় পড়ি৷ কিন্তু সবকিছুকেই সহজভাবে নেওয়া উচিত'', বলেন ইসাবেল গ্রোনাক ভালৎস৷
রূঢ় এক বাস্তবতা
সামাজিক চাপের পাশাপাশি রূঢ় এক বাস্তবতাও সন্তান নেওয়ার ইচ্ছাকে রাশ টেনে দেয়৷ আর তা হলো আর্থিক বিষয়টি৷ সন্তান যতই ভালোবাসার হোক না কেন, তাদের জন্য খরচও তে কম নয়! এই চিন্তাটা মাথায় থাকে অনেকের৷ ‘‘আর্থিক দিক দিয়ে আমাদের কিছুটা দেখে শুনে চলতে হয়৷ বাচ্চা না থাকলে এমনটি হতো না৷ কিন্তু সন্তানের বেলায় এত হিসাব নিকাশ করে চলা যায় না৷'' এই মন্তব্য ইসাবেলের স্বামী আন্ড্রেয়াস ভালৎস-এর৷
‘‘আমাদের প্রয়োজন সাহায্য ও সহযোগিতা৷ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে জার্মানির মেয়েরাও সন্তান চাইবেন৷ আমরা তো বাচ্চা চাই৷ তারা যে আনন্দ বয়ে আনে'', বলেন তিন সন্তানের জননী ইসাবেল গ্রোনাক ভালৎস৷