জার্মানিতে নারী আন্দোলন: এক সুদীর্ঘ ইতিহাস
১৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জার্মান নারীরা সমানাধিকারের জন্য লড়ছেন৷ এই লড়াইয়ে তাঁদের হারজিত দুই-ই ঘটেছে৷ তবে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো জার্মানিতেও এ লড়াই চলছে– চলবে৷
জার্মান নারী আন্দোলনের ‘কোকিল’
লুইজে অটো-পিটার্স (১৮১৯-১৮৯৫) ছিলেন জার্মানিতে নারী আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ ও ‘সাধারণ জার্মান নারী সমিতি’-র যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা (১৮৬৫)৷ লেখিকা হিসেবে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘গানের পাখি৷’
হেলেনে লাঙ্গে
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি জার্মানিতে মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়াশুনার বিশেষ চল ছিল না৷ ১৮৯০-এর দশকে মেয়েদের স্কুল শিক্ষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার পুরোভাগে ছিলেন শিক্ষক ও নারীবাদী হেলেনে লাঙ্গে (১৯৪৮-১৯৩০)৷ মহিলাদের ভোটাধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন তিনি৷
প্রোলেতারীয় নারী আন্দোলনের জননী
শ্রমিক সংগঠনে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব, মহিলাদের ভোটাধিকার ও গর্ভপাতের অধিকারের দাবিতে সক্রিয় ও সোচ্চার ছিলেন ক্লারা সেটকিন (১৮৫৭-১৯৩৩)৷ ক্লারা সেটকিন সে আমলেই জার্মান দায়রা আইনের ২১৮ নং ধারাটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন৷ গর্ভপাতবিরোধী এই ধারাটির বিরুদ্ধে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকেও জার্মানিতে তুলকালাম হয়ে গেছে৷ আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতিষ্ঠাতেও ক্লারা সেটকিনের অবদান ছিল৷
আনিটা আউগ্সপুর্গ
আনিটা আউগ্সপুর্গ (বাঁয়ে) ও তাঁর সঙ্গিসাথীরা সামাজিক রীতিনীতির পরোয়া করতেন না৷ আউগ্সপুর্গ তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে থাকতেন৷ দু’জনেই মাথার চুল ছোট করে কাটতেন ও পুরুষালি পোশাক পরতেন৷ আইনজীবী হিসেবে তিনি জার্মানিতে মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন (যে অধিকার শেষমেষ ১৯১৮ সালে আদায় হয়)৷ যৌনকর্মীদের অধিকারের জন্যও তিনি সক্রিয় ছিলেন৷ তাঁর সমিতি একাধিক আন্তর্জাতিক মহিলা সংগঠন সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট ছিল৷
নাৎসি আমল
নাৎসিরা ছিল নারীমুক্তিবিরোধী৷ তাদের চোখে নারী অধিকার গোষ্ঠীগুলি ছিল ইহুদি অথবা কমিউনিস্টদের সৃষ্ট৷ নাৎসিদের মতে নারীর ভূমিকা হলো ঘরণী তথা জননীর৷ অপরদিকে পুরুষরা যখন রণাঙ্গণে, তখন এই মহিলাদেরই কলকারখানায় গোলাবারুদ উৎপাদনের কাজে হাত লাগাতে হয়েছে জার্মানিতে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
১৯৪৫ সালে জার্মানির অধিকাংশ বড় বড় শহর তখন বিধ্বস্ত৷ সেই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নতুন করে দেশ গড়ে তোলার কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন জার্মানি মহিলারা৷ অপরদিকে নারী অধিকার আন্দোলনগুলিও যেন কিংবদন্তির ফিনিক্স পাখির মতো সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে মাথা তোলে৷
গর্ভনিরোধ
১৯৬১ সালে জার্মানিতে গর্ভনিরোধক পিল বা বড়ির চল হয়৷ গোড়ায় শুধু বিবাহিত মহিলাদের এই পিল ব্যবহার করার অনুমতি ছিল; ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশনে লেখা থাকতো, মহিলাদের মাসিকের বেদনা উপশমের জন্য এই পিল দেওয়া হচ্ছে৷
আটষট্টির ছাত্র আন্দোলন
১৯৬৮ সালে গোটা পশ্চিম জার্মানি জুড়ে যে ছাত্র আন্দোলনের অবতারণা ঘটে, তার লক্ষ্য ছিল কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার – এবং সেই সঙ্গে যৌন স্বাধীনতাও বটে৷ কিন্তু গোটা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব পুরুষ অধ্যুষিত হওয়ায় মহিলারা নারীমুক্তির জন্য পৃথকভাবে পথে নামেন৷ ছবিতে প্রদর্শিত নিশানটিতে লেখা রয়েছে: নারীমুক্তি = শ্রেণীসংগ্রাম৷
গর্ভপাত
২১৮ নং অনুচ্ছেদের দরুণ সত্তরের দশকেও জার্মানিতে গর্ভপাত দায়রা অপরাধ বলে গণ্য হতো৷ ১৯৭১ সালে জার্মানির ‘স্ট্যার্ন’ পত্রিকা ৩৭৪ জন মহিলার নাম ছাপে, যারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে, তাঁরা গর্ভপাত করিয়েছেন৷ তারপর থেকে সংশ্লিষ্ট আইনটি একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে ও বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ও শর্তে গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছে৷
অ্যালিস শোয়ার্ৎজার
জার্মানিতে নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃত অ্যালিস শোয়ার্ৎজার জার্মানির প্রথম নারীবাদী পত্রিকা ‘এমা’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৭ সালে৷ মহিলাদের জন্য সৃষ্ট পত্রিকাটিতে ফ্যাশন ও গ্ল্যামারের চেয়ে রাজনীতির উপরই বেশি জোর দেওয়া হতো৷
কর্মের স্বাধীনতা
ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৭৭ সাল অবধি জার্মানিতে মহিলারা স্বামীর অনুমতি না নিয়ে চাকুরি করতে পারতেন না৷
পথ যদি না শেষ হয়
শুধু জার্মানিতেই নয়, সারা বিশ্বে নারী আন্দোলন বহু লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে বটে, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে৷ জার্মানির সংসদ বা বড় বড় শিল্পসংস্থাগুলিতে আগের মতোই পুরুষদের আধিপত্য৷ জার্মানিতে আজও অনেক ক্ষেত্রে মহিলাকর্মীরা পুরুষ সহকর্মীদের মতো একই কাজ করে কম বেতন পান৷ আর যৌন হয়রানি তো আছেই৷ কাজেই প্রত্যেক নারী দিবসের উপজীব্য হওয়া উচিত – আগের নারী দিবসের দিকে অগ্রণী হও৷