জার্মানরা ‘‘বিশ্বায়ন চ্যাম্পিয়ন'' হলো কী করে?
১০ জানুয়ারি ২০১৫আর্থিক সংকট শুরু হওয়ার সময় থেকেই দেখছি: ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো জার্মানিরও বিপদে পড়ার কথা এবং বিপদে তারা পড়েছিলও বটে৷ মার্কিন মুলুকে বাড়ি বন্ধকি বাজারের ‘ক্রাইসিস'-এ জার্মান ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ মাঠে মারা যায়৷ কিন্তু তাদের সেই ক্ষতি সামলে নেবার ক্ষমতা ছিল, স্বাভাবিকভাবেই – কেননা যে সব জার্মান ব্যাংকের তা ছিল না, তাদের মধ্যে অতি অল্পই ও ধরনের ঝুঁকি নেবার মতো বোকামি করেছিল৷
গ্রিসে আজও যে টানাপোড়েন চলেছে, তা হলো পুরাতন সব ব্যয়বহুল অভ্যাস ছেড়ে নতুন ‘রোগা হওয়ার ডায়েট' চালু করা৷ উদাহরণস্বরূপ: যথেচ্ছ সরকারি কর্মচারী নিয়োগ; অথবা স্বাস্থ্য সেবায় ডাক্তারদের যথেচ্ছ ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স টোমোগ্রাফি করা; আয়করের প্রশ্নে এলে, কর ফাঁকি দেওয়া৷ যে গাছের ডালে বসে আছি, সে ডাল কাটলে যে কি হয় – এটা বুঝতে সব দেশের মানুষেরই কষ্ট হয়৷ কিন্তু যে দেশের মানুষ এই সহজ হিসেবটি সেরা বোঝে, সে দেশটি হলো জার্মানি৷
জার্মানরা বাকিদের মতো ভালোমন্দ সবই করে থাকে, শুধু বাড়াবাড়িটা ছাড়া৷ কিভাবে জানি না, ওরা শেষ মুহূর্তে সামলে নেয় – এটা বলছি নতুন, যুদ্ধোত্তর, গণতান্ত্রিক জার্মানির কথা৷ এদেশে সামাজিক সুযোগসুবিধার বাড়াবাড়ি হলে, এক সামাজিক গণতন্ত্রী চ্যান্সেলর – গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার – তাঁর নিও-লিবারাল এজেন্ডা ২০০০ কর্মসূচি দিয়ে দেশকে আসন্ন আর্থিক সংকটের জন্য ফিট করে দেন৷ ওদিকে শ্রোয়ডার-পরবর্তী এসপিডি নেতারা কেঁচে গণ্ডূষ করে সর্বনিম্ন মজুরি ইত্যাদি এনে খাতাপত্রে জার্মান শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতির সর্বনাশ করছেন বলে মনে হলেও, এর কিছুদিন পরেই দেখা যাবে, ওটাই ছিল পরবর্তী শ্রম বাজারের সংকট সামাল দেবার সেরা পন্থা৷
এভাবেই একটির পর একটি ক্ষেত্রে জার্মান রাজনীতিক তথা নাগরিকরা নমনীয়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন৷ যে জার্মানিতে আরটিএল গোত্রীয় বেসরকারি মালিকানার টেলিভিশন অনুষ্ঠান এসেছে সবার পরে, সেই জার্মানিতেই কিন্তু সরকারি টেলিভিশনও সব টেলিভিশন গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত বাৎসরিক ফি-র কল্যাণে দিব্যি বেঁচে রয়েছে৷ এদেশে রেলওয়ে, ডাক ও তার বিভাগ ইত্যাদি বিনা ঝক্কিতে সরকারি থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় – যেমন কিছু মানুষের চাকরি যায়, তেমন বহু মানুষের নতুন চাকরি হয়৷ এদেশে কয়লাখনি বন্ধ করা যেমন সহজ, তেমন আণবিক চুল্লি বন্ধ করাও অসম্ভব নয়৷ এদেশে বড় বড় শিল্পসংস্থাগুলোর খাতির অনেক হলেও, তাদের যথেচ্ছাচারের অধিকার দেওয়া হয়নি, একচেটিয়া ব্যবসার তো নয়ই৷
জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের পর দশকের পর দশক ধরে একটি নতুন কর চলে আসছে, যার নাম ‘সংহতি চাঁদা'৷ সেই বিপুল পরিমাণ অর্থে সাবেক পূর্ব জার্মানিকে গড়েপিটে পশ্চিমের মতো করে নিচ্ছে জার্মানরা ইতিমধ্যে পুবের পুনর্নির্মাণ একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে, ওদিকে পশ্চিমের কিছু কিছু শহর-নগরের এমন হাঁড়ির হাল যে, সেখানকার রাস্তার গর্ত সারানোর জন্য এবার ‘সংহতি চাঁদা' বজায় রাখতে হচ্ছে – এবং তা নিয়ে জার্মানির মানুষজন যে একেবারে বিদ্রোহ করতে বসেছেন, এমন নয়, কারণ –
ঐ যে বললাম, নমনীয়তায় চ্যাম্পিয়ন না হলে, বিশ্বায়নেও চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না৷ জার্মানরা হাইব্রিড গাড়িতে এসেছে সবার পরে, কিন্তু এবার লস এঞ্জেলেসে বিশ্বের প্রথম পুরোপুরি স্বয়ংচালিত গাড়ি পরিবেশন করল মার্সিডিজ-বেঞ্জ৷ অন্যান্য দেশ যখন পণ্য রপ্তানি করতে ব্যস্ত, জার্মানরা তখন পণ্য তৈরির যন্ত্রপাতি রপ্তানি করে চলেছে৷ অন্যরা যখন বিশ্বায়নের ক্ষতির দিকটা দেখছে, জার্মানরা তখন বিশ্বায়নের যাবতীয় সুযোগসুবিধা নিয়ে ব্যবসা ফাঁদছে, যে ব্যবসার ফাঁদে চীন বা রাশিয়ার মতো দেশেরও পা না দিয়ে উপায় নেই...
তাই ইউরোপীয় শান্তির ক্ষেত্রেও আজ জার্মানদেরই প্রথম ডাক পড়ে৷ কী আর করা: বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছো...