জামায়াত নেতা আজহারের ফাঁসি
৩০ ডিসেম্বর ২০১৪মঙ্গলবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার ১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ পড়ে শোনায়৷ ট্রাইব্যুনালের অন্য দু'জন সদস্য হলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন৷
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২২৫ ব্যক্তিকে গণহত্যা, চারজনকে হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে৷
এছাড়া আজহারের নির্যাতনের শিকার একজন বীরাঙ্গনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে দাবি জানিয়েছে প্রসিকিউশন৷ আজহারের বিরুদ্ধে ঐ বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন৷ অভিযোগ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর টাউন হলে স্থাপিত পাকিস্তানি ও রাজাকার ক্যাম্পে আজহারের নেতৃত্বে ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি৷
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে এ সব অপরাধ সংঘটন করেছিল এটিএম আজহার৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় আল-বদরের নেতৃত্বে থাকায় তার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি-র (ঊর্ধতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ আনা হয়৷
২০১২ সালের ১৫ই এপ্রিল আজহারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়৷ একই বছরের ২২শে আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ প্রসঙ্গত, ঐ দিনই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল৷
২০১৩ সালের ১৮ই জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে এবং ২৫শে জুলাই অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল৷ একই বছরের ১২ই নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে ছ'টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আজহারের বিরুদ্ধে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়৷ তদন্ত কর্মকর্তা ইদ্রিস আলীসহ ১৯ জন সাক্ষী উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ৷ ২০১৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়৷ এর পর দুই পক্ষের যুক্তি-তর্ক শেষে চলতি বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে ট্রাইব্যুনাল-১৷
রায়ের জন্য মঙ্গলবার সকাল ন'টার দিকে আজহারকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়৷ সোমবার রাতে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল৷
আজহারের বিরুদ্ধে ছয় অভিযোগ
আজহারের বিরুদ্ধে প্রসিকিশনের আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগ হলো: ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ২৭শে মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটককে শারীরিক নির্যাতন করা এবং ৩রা এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ‘ব্রাশফায়ার' করে তাদের হত্যা ৷
দ্বিতীয় অভিযোগ: একাত্তরের ১৬ই এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ৷
তৃতীয় অভিযোগ: একই বছরের ১৭ই এপ্রিল নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২০০-র বেশি নিরীহ লোক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ৷
চতুর্থ অভিযোগ: ১৭ই এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পত্নীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা ৷
পঞ্চম অভিযোগ: ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো৷ একই সঙ্গে নারীসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যা৷
ষষ্ঠ অভিযোগ: একাত্তরে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়৷ একই বছরের ১লা ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে একজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম৷
আজহার নামা
একাত্তরে আজহার ছিল জামায়াতের সেই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি৷ পদাধিকার বলেই আল-বদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডারও ছিল আজহার৷
তদন্তে বলা হয়, আজহার রংপুরের টাউন হল বধ্যভূমির ৭০ জনের সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মীর নেতৃত্ব দিত৷ যেটি ব্যবহৃত হতো পাকিস্তানিদের টর্চারসেল হিসেবে৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে আজহার রংপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে৷ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে তখন নিজামী ও মুজাহিদের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়া চলছিল৷ তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আজহার৷
এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দুই-একদিন পর আজহার পাকিস্তানে পালিয়ে যায়৷ আর সেখান থেকে চলে যায় সৌদি আরবে৷ এরপর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ফিরে জামায়াতের রাজনীতি শুরু করে এটিএম আজহারুল ইসলাম, যদিও ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত রংপুর যেতে সাহস হয়নি তার৷
পঞ্চদশ রায়
সৈয়দ মুহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পঞ্চদশ রায় দিল ট্রাইব্যুনাল৷ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়৷
এর আগের ১৪টি রায়ের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন, জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী, ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মুহম্মদ কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷
মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড, দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
এর মধ্যে আপিলের রায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হলে গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর তা কার্যকর করা হয়৷ সাঈদীর আপিলে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷ তবে কামারুজ্জামানের আপিলে ফাঁসির আদেশই বহাল থাকে৷
যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যেই গত ৩০শে আগস্ট ৮৩ বছর বয়সে মারা যায় আলীম৷ এছাড়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩শে অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায় ৯২ বছর বয়সি জামাতগুরু গোলাম আযম৷