বাংলাদেশে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের অনেক নেতার সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন অনেকটাই প্রমাণিত৷ যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তবে তা তাদের অতীত অপরাধকে অস্বীকার করে নয়৷ প্রক্রিয়া যাই হোক, আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত নেতাদের বিচার কার্যকর করতে পারায় বাংলাদেশে সন্তুষ্ট অনেকে৷ আর এটা হাসিনা সরকারের জন্য এক বড় অর্জন বটে৷
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের একটি দাবিও উঠেছে৷ বর্তমান সরকারের সমর্থক অনেকে সেই দাবির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন৷ সরকারের অবস্থান এক্ষেত্রে এখনো পরিষ্কার নয়, তবে জামায়াতের অনেক নেতার ফাঁসি কার্যকরের পর এটা পরিষ্কার যে, হাসিনা সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছে৷ ফলে জামায়াত নিষিদ্ধের জোরালো দাবি যারা করছেন, তাদের কথা বর্তমান সরকার যে শুনবে না সেই নিশ্চয়তা দেয়া যায় না৷
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যে ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা উপভোগ করছে তাতে একটি দলকে নিষিদ্ধ করা তাদের জন্য এমন বড় কোনো ব্যাপার নয়৷ কার্যত বিরোধীদলহীন একটি সংসদে যে কোনো আইনই পাস করিয়ে নেয়া কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র৷ সমস্যা হচ্ছে, সরকারের এই অসীম ক্ষমতা তাদের মধ্যে একরকম একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা ফুটিয়ে তুলছে৷ যেকোনো ঘটনায় তারা কাউকে না কাউকে দোষারোপ করে পার পেয়ে যাচ্ছে৷
আর এই দোষারোপের একটা বড় অংশ এখন পড়ছে জামায়াতে ইসলামীর ঘাড়ে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের একের পর এক ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এমনিতেই দলটি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে৷ সঙ্গে যোগ হয়েছে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা৷ সেটা বাস্তবসম্মত হোক বা না হোক, আর জামায়াতের পক্ষে সেগুলোর প্রতিবাদ করাও এখন কঠিন৷
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাই জামায়াতের অবস্থান এখন অনেকটা সেই ‘নন্দ ঘোষের' মতো, যত দোষ তার৷ গত কয়েকবছরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়৷ গতবছর যখন একের পর এক ব্লগারকে খুন হতে শুরু হয় বাংলাদেশে, তখন সরকারের তরফ থেকে, সরকার সমর্থকদের তরফ থেকে প্রচার করা হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির এ সব করছে৷ এটা সত্য যে, যেসব ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট গত বছর খুন হয়েছেন তারা সবাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে ছিলেন, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যারা সক্রিয়ভাবে রাজপথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, রাজপথ কাপিয়েছেন, সেই ব্লগারদের তালিকায় তারা কেউ ছিলেন না৷
বরং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো একেকজনকে হত্যার পরে ‘জঙ্গিদের বিবেচনায়' কেনো তাদের হত্যা করা হয়েছে, তার বিস্তারিত কারণ জানিয়েছে৷ সেই কারণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ তবে জঙ্গিদের দেয়া কারণগুলোতে নিহতদের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে তাদের সমর্থনের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ আর এ সব হত্যাকাণ্ডের ফলে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেরকম কোনো নজিরও নেই৷
শুরুর দিকে জঙ্গিদের লক্ষ্য পরিষ্কারভাবেই ছিল নাস্তিক ব্লগার, লেখকরা৷ কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী জামায়াতের উপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে৷ ফলে জঙ্গিরা নিজেদের অবস্থান আরো শক্ত করার সুযোগ পেয়েছে যার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেছে জুলাইয়ে গুলশানে জঙ্গি হামলার মধ্য দিয়ে৷ ১৮ জন বিদেশিকে ঠাণ্ডা মাথায় কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করেছে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের একদল তরুণ, যাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নীতিগত বা আদর্শগতভাবে কোনো সম্পর্কই নেই৷
‘ইসলামিক স্টেট' বা আইএস-এর আদর্শ অনুসরণ করা জঙ্গিদের কাছে বরং জামায়াত নেতারা হচ্ছে ‘মুরতাদ', মানে স্বধর্মত্যাগকারী৷ বর্তমান সরকারে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করায় বরং সন্তুষ্ট উগ্রপন্থিরা, কেননা জঙ্গিদের বিবেচনায় এসব নেতারা প্রকৃত মুসলমান নয়, বরং ধর্ম ব্যবসায়ী৷ ফলে তাদের ‘হত্যার' কাজটা প্রকারান্তরে সরকারই করে দিচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে৷ আইএস-এর মুখপত্র ‘দাবিক' ম্যাগাজিনে এ সব বিষয় একাধিকবার লিখেছে জঙ্গিরা৷
ফলে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে ভাবাটা নেহাতই এক কল্পনাপ্রসূত ব্যাপার৷ বরং বাস্তবতা হচ্ছে, জামায়াত এমন একটি ইসলামী দল, যারা নারী নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন, অর্থাৎ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে৷ আর এখানেই ইসলামিক স্টেট বা সেরকম উগ্রপন্থি দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের সবচেয়ে বড় বিরোধ৷ ইসলামিক স্টেট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নারী নেতৃত্বকে শুধু অস্বীকারই করে না, এগুলোকে মনে করে বড় ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷
কেউ কেউ অবশ্য বলতে চান, জামায়াতে ইসলামীর কোনো কোনো সমর্থক এখন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে৷ এই দাবির কতটা ঠিক সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ এক্ষেত্রে ইরাকের দিকে তাকানো যেতে পারে৷ পশ্চিমাদের সামরিক অভিযানে সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর পর ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে যায়৷ পশ্চিমাদের সমর্থন পেয়ে সংখ্যালঘু শিয়ারা সুন্নিদের উপর ব্যাপক অবিচার, নিপীড়ন শুরু করে৷ সরকার, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো হারাতে থাকে সুন্নিরা৷ তাদের পুরোপুরি কোনঠাসা করে ফেলা হয় সরকারি উদ্যোগে, পশ্চিমাদের সহায়তায়৷
কিন্তু সুন্নিদের এভাবে কোনঠাসা করে ফেলা যে বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি পশ্চিমারা সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি৷ তাদের বিরুদ্ধে সরকারি উদ্যোগে নিপীড়নকে কাজে লাগিয়ে একসময় প্রায় নিস্তেজ হয়ে যাওয়া একটি জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট' নামে বড় আকারে ফিরে এসেছে৷ আইএস সাদ্দামের অনুগত সেনাবাহিনীর বড় বড় অফিসার থেকে শুরু করে অনেক সেনা সদস্যকে নিজেদের দলে টেনে নিতে সমর্থ হয়েছে৷ আর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নামে আইএস-এর পক্ষে অস্ত্র হাতে নেয়া সুন্নি ইরাকির সংখ্যা কম নয়৷ অথচ সাদ্দামের পতনের পর এদের যদি উপযুক্ত পুর্নবাসন করা হতো, তাহলে হয়ত আইএস আজকে এতটা ক্ষমতাশীল হতে পারতো না৷
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ইরাকের মতো নয়৷ তবে এখানেও সরকারের ছত্রছায়ায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ব্যাপক আকারেই চলছে৷ জামায়াত, শিবিরের বেশি কিছু সদস্যকে গত কয়েকবছরে ক্রসফায়ারের নামে হত্যার অভিযোগ রয়েছে, অনেককে করে দেয়া হয়েছে পঙ্গু৷
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার বিরোধী পক্ষের উপর দমননীতি বজায় রাখলে সেটা উগ্রপন্থিদের আরো শক্তিশালী করে তুলবে৷ কেননা, আবদ্ধ পরিবেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে বেশি৷ আর শুধু জামায়াত নিষিদ্ধ করে এবং তাদের সমর্থকদের উপর নির্যাতন অব্যাহত রেখে সেটা রোখা সম্ভব হবে না৷ বরং উগ্রপন্থিদের শক্তি বাড়াতে তা আরো সহায়ক হতে পারে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷