জাতীয় পার্টি : ভোট এলে নতুন রূপে পুরোনো ‘নাটকীয়তা'
২৩ আগস্ট ২০২৩সকালের এই ঘোষণার পর সন্ধ্যায় রওশন নিজেই দাবি করেছেন, এ বিবৃতির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
হঠাৎ করে জাপায় কেন এই নাটকীয়তা? রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই নাটকীয়তার এখানেই শেষ নয়। নির্বাচন পর্যন্ত এমন নাটকীয়তা আমরা দেখতেই থাকবো। এই দলটিতে তো নাটকীয়তার শেষ নেই। এগুলো দেখে দেশের মানুষ অভ্যস্ত। এর মূল কারণ হলো, এই দলটির যিনি মালিক তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, দলে তার একাধিপত্য ছিল। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর শরিককরা এটা নিয়ে হাঙ্গামা করছেন। রাজনৈতিক দল পারিবারিক সম্পত্তি হওয়ার নির্মম উদাহরণ হলো জাতীয় পার্টি। ফলে এর সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। এখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটা আরো বাড়বে বলেই আমার ধারণা।”
মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে রওশন এরশাদের সই করা কাগজটি সামনে আসার পর জাপার ভেতরে-বাইরে উত্তাপের পাশাপাশি খবরটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও চলে নানামুখী আলোচনা-বিতর্ক। সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানান, প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া। মসীহ বলেন, রওশন এরশাদ এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেন না। নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার প্রশ্নই আসে না। আমাদেরই কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এটি ছড়িয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছা করলেই নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারেন না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে হয়।
এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা নিয়ে আমরা খুবই বিব্রত। এমন একজন মানুষের নাম করে এই বিবৃতি দেওয়া হয়, যার ব্যাপারে আমরা কিছুই বলতে পারি না। বেগম এরশাদকে আমরা সম্মান করি। কারা এই কাজ করছে, সেটা আমরা সবাই জানি। তারা কিন্তু দল থেকে বহিস্কৃত। ফলে দল থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। বেগম এরশাদ চাইলে তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। উনি তো আমাদের দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সবাই ওনাকে সম্মানের চোখে দেখেন।”
গঠণতন্ত্র অনুযায়ী এটা সম্ভব কিনা জানতেই চাইলে তিনি বলেন, "প্রথমত উনি তো নিজেই অস্বীকার করেছেন। আর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছা করলেই চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিতে পারে না। গঠনতন্ত্রের বাইরে কেউই কিছু করতে পারবে না। জাপার নেতাকর্মীরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছেন। জাপা থেকে বহিষ্কৃত কিছু ব্যক্তি ম্যাডামের নাম ব্যবহার করে এমন কাজ করছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এমন ঘটনার সুযোগ নেই।”
নির্বাচন আসলেই কেন এই পরিস্থিতি হয়? জনাব চুন্নু বলেন, "এবার আগের মতো হবে না। কারণ সাংগঠনিক কাঠামোতে যারা আছেন তাদের কেউই ম্যাডামের সঙ্গে নেই।” এ বিষয়ে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আজই (বুধবার) সন্ধ্যায় তিনি চার দিনের সফর শেষে ভারত থেকে দেশে ফিরবেন। তবে ফোনে উনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনিও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত।” ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে ২০ আগস্ট তিনি দিল্লি যান।
এই ঘটনার পর থেকে জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতারাও বিব্রত। কেউ মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। এ বিষয়ে জানতে বেগম রওশন এরশাদ বা তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ'র সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের ঘনিষ্ট একজন জানিয়েছেন, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তারা আসলে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। এমনকি দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদও বিব্রতকর এই পরিস্থিতি নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি।
খবরটি যেভাবে ছড়ায়
রওশন এরশাদের ‘মুখপাত্র' হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কাজী মামুনুর রশিদের বেতনভুক্ত একটি প্রেস উইং রয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রেস উইংয়ের ‘প্রেস নোট (জাপা)' নামে একটি গ্রুপ রয়েছে। এই গ্রুপে মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪০ প্রথমে প্রতিবেদন আকারে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয়। এর পাঁচ মিনিট পর দুটি চিঠি পোস্ট করা হয়। এর একটিতে দেখা যায়, জাপার প্যাডে মঙ্গলবারের তারিখে রওশন নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করার প্রেস বিজ্ঞপ্তি, যাতে রওশনের স্বাক্ষরও রয়েছে। এতে লেখা ছিল, "আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।”
পোস্ট করা আরেকটি চিঠি ছিল হাতে লেখা। ‘সভার কার্যবিবরণী বহি' নামের একটি প্যাডে হাতে লেখা হয়, "মামলা-মোকদ্দমায় জাতীয় পার্টির চলমান অচলাবস্থা নিরসনে পার্টির চার জন কো-চেয়ারম্যান দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নে উল্লিখিত পার্টির চার জন কো-চেয়ারম্যান প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে দলের ক্রান্তিকাল মোকাবিলায় অস্থায়ী ভিত্তিতে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পণ করেন।” হাতে লেখা এই চিঠিতে জাপার চার জন কো-চেয়ারম্যানের নাম ও তাদের স্বাক্ষর দেখানো হয়। তারা হলেন, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম। এছাড়া পার্টির দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্না ও শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নাম ও স্বাক্ষরও দেখানো হয়। হাতে লেখা এই চিঠিতে তারিখ রয়েছে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। অথচ, জাপার এই ছয় নেতার সুপারিশটি রওশন গতকাল গ্রহণ করেছেন বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি, যাদের নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই গতকাল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুয়া।'
যারা এই ধরনের ভুয়া বিবৃতি দিচ্ছে দল তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয় না? দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "চেয়ারম্যান দেশে আসলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন দলের যে সাংগঠনিক কাঠামো তাতে বিভেদ সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই। তবে এটা সত্যি যে, সরকারী দল সব সময় জাতীয় পার্টিকে ভাঙার চেষ্টা করেছে। কয়েক দফা ভাঙার পরও জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা যেমন কমেনি, তেমনি আসনও কমেনি। ফলে সরকারী দলের এই চেষ্টা সব সময় থাকে। এবার তাতে কাজ হবে না। এটা রাজনীতির একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যারা দলের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের শাস্তি দেওয়া দরকার। যারা এই কাজ করছে তাদের সঙ্গে সরকারী কোন না কোন মহলের সম্পর্ক আছে।”
যেভাবে সরকারি দলের যোগসূত্র খোঁজা হচ্ছে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত শনিবার গণভবনে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ। বৈঠকে রওশনের সঙ্গে ছিলেন তার পুত্র ও রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহিগর আল মাহি (সাদ এরশাদ), নিজের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ ও মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ। শনিবারের বৈঠকের তিন দিনের মাথায় কাজী মামুনের নিয়োগকৃত প্রেস উইং থেকে এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয়। আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরদিনই রবিবার সাদ, গোলাম মসীহ ও কাজী মামুনসহ রওশনপন্থিরা সভা করে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই দলের কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা দেন। এমনকি রওশনের নেতৃত্বে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে বলেও ঘোষণা দেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রওশনের সঙ্গে থাকা এসব লোকজন গণভবনে বৈঠকের তিন দিনের মাথায় এমন প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা দিতে চেয়েছে যে এর পেছনে সরকার প্রধানের ইঙ্গিত রয়েছে। এমনকি গণভবনে বৈঠকের পরদিনই নিজেরা সভা করে কাউন্সিলের কথা জানিয়েও তারা এমন একটি বার্তা দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। অথচ এই ঘটনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোন সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এর আগেও রওশনের সঙ্গে থাকা এসব লোক এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন রওশন। জি এম কাদেরও গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ডাকে। পরদিন রাতে আচমকা রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বিবৃতি আসে। যদিও ৪৫ মিনিট পর ঘোষণাটি স্থগিত করা হয়।