জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ‘ভয়ের পরিবেশ’
১৫ ডিসেম্বর ২০১৮যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)-এর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বৃহস্পতিবার দাবি করেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীন ও বিরোধীকণ্ঠকে দমন করছে৷ পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পথে যাতে কেউ বাধা না হয়- এটাই তাদের উদ্দেশ্য৷''
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের সমর্থক ও নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার, খুন ও গুমের শিকার হচ্ছেন৷ এর ফলে বাংলাদেশে এমন এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিপন্থি৷''
বাংলাদেশে নির্বাচনি প্রচারণায় সহিংসতা রোধ এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনার সরকারকে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও অন্যান্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া উচিত বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে৷
এইচআরডাব্লিউ গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দাবি করছে, ‘‘বিধিবহির্ভূত গ্রেপ্তার, বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের সাজা ও ক্ষমতাসীন দলের যুব ও ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে সহিংসতা ও ভয় দেখানোর বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে৷ এসব কারণে নির্বাচনের আগে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে৷ এ অবস্থায় নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷''
মানবাধিকার সংস্থাটি আরো বলছে, ‘‘বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভয় দেখিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে৷ আর নির্বাচনি প্রচারণার শুরুতেই রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে বহু মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে৷''
বিএনপির বরাত দিয়ে এইচআরডাব্লিউ জানায়, সেপ্টেম্বর থেকে এপর্যন্ত বিএনপি'র তিন লাখের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ এইসব মামলায় কয়েক হাজার বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে৷
বিবৃতিতে বিএনপির অভিযোগ উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘‘নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন করছে৷ যেখানে বিএনপির ১৪১ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে কমিশন, সেখানে আওয়ামী লীগের মাত্র তিন প্রার্থী বাদ পড়ে৷ যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা সবাইকে নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন৷''
এদিকে, সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ সংবাদ মাধ্যমগুলো সেল্ফ-সেন্সরের (স্বনিয়ন্ত্রণ) মধ্যে কাজ করছে৷''
বাংলাদেশের প্রিন্ট, অনলাইন এবং টেলিভিশনের ৩২ জন সাংবাদিকের নেয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তারা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে৷ বাংলাদেশের অন্তত দু'জন সম্পাদকের মতামত প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে মানব জমিন সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, ‘‘একজন প্রতিবেদক দিনের পর দিন পরিশ্রম করে একটি প্রতিবেদন তৈরির পরও যখন সেটা আমি ছাপতে পারি না, তখন সম্পাদক হিসেবে আমার খারাপ লাগে৷ কিন্তু প্রতিবেদককে রক্ষার স্বার্থে আমাকে না ছাপার সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ কেননা, এটি প্রকাশের ঝুঁকি সম্পর্কে আমি জানি৷''
আর দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘‘আগে কোনো উদ্বেগ ছাড়াই আমি নিয়মিত কলাম লিখতাম৷ কিন্তু এখন লিখি কালেভদ্রে৷''
কেন প্রতিবেদন প্রকাশ করা যায়না, সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ এই প্রতিবেদককে শুধু বলেন, ‘‘আপনিওতো জানেন কেন প্রকাশ করা যায়না৷ বোঝেন না আপনি? আপনিওতো বোঝেন৷''
মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যা বলেছে তার সাথে দ্বিমত করার কোনো জায়গা নাই৷ গত কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি সারাদেশেই বিরাধী দল মতের ওপর নির্যাত নিপীড়ন চলছে, গ্রেপ্তার চলছে, বাড়িঘর, অফিস-আদালত ভাঙচুর চলছে৷ বিরোধী শিবিরের সমর্থক যারা আছেন তারা খুব একটা কাজ করতে পারছেন না৷''
আওয়ামী লীগের লোকজনের উপরওতো হামলা হচ্ছে৷ দু'জনতো এরইমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন৷ এই পরিস্থিতির জবাবে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, তারাও হামলা-হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় যে বিরোধীদের যারা হামলা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা শিকার হচ্ছেন সরকারি বাহিনীর হাতে৷ আওয়ামী লীগের উপর হামলা দুঃখজনক৷ নির্বাচনি সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ আর এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাচ্ছিনা৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘যেকোন ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই৷ রাষ্ট্রকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে৷ রাষ্ট্রকেই এটা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে৷''