1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জাতিসংঘে ভেটো দেয়ার অধিকার কি ভারত পাবে?

গৌতম হোড়
১৮ মার্চ ২০২২

আন্তর্জাতিক জোট তো আর কম দেখলো না ভারত। একটা সময় ভারত ছিল নির্জোট আন্দোলনের অন্যতম নেতা।

https://p.dw.com/p/48hSM
England COP26 in Glasgow
ছবি: Jeff J Mitchell/Pool via REUTERS

নির্জোট মানে কোনো জোটেই নয়। সেই সময়ের বিশ্ব ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের বিশ্ব। একদিকে অ্যামেরিকা, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর মাঝখানে কোনো জোটে না থাকার ঘোষণা দেয়া নির্জোট আন্দোলনের দেশগুলি, যার মধ্যে অন্যতম ভারত, যুগোস্লাভিয়া, মিশর, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া। ১২০টি উন্নয়নশীল দেশ নির্জোট আন্দোলনের শরিক হয়েছিল।

সেটা জওহরলাল নেহরুর সময়। তিনি এবং যুগোস্লাভিয়ার টিটো, মিশরের নাসের, ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নোরা তখন মাঝেমধ্যেই খবরের শিরোনামে থাকতেন। নীতি হিসাবে নির্জোট অবশ্যই অসাধারণ। কোনো জোটে না গিয়েও যদি টিকে থাকা যায়, তাহলে তার থেকে ভালো অবস্থান আর হয় না। তখন বিশ্ব তো অ্যামেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই মেরুতে বিভক্ত। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও ঠান্ডা লড়াইয়ে বিশ্ব দুই ভাগ। তার মধ্যেই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলাটা কম কথা নয়।

তবে ভারতের বিরুদ্ধে বরাবরের অভিযোগ ছিল, দিল্লি সবসময়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে থেকেছে। তাহলে নির্জোট হলো কী করে? সেই তো একদিকে হেলে থাকার ঘটনা। এখন ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আর নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন জোটও নেই। চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়ার মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলি থেকে কমিউনিস্ট শাসকরা বিদায় নিয়েছেন। ফলে  নির্জোটের ধারণাই বিদায় নিয়েছে।

এখন পুরো পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে গেছে। যে অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে দাদাগিরি নিয়ে এত অভিযোগ, তাদের দিকেই ভারত ক্রমশ হেলে পড়েছে, চীন বড় শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খারাপ থেকে খুব খারাপ হয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত বেড়েছে। এ সবই এখন বাস্তব, খুব বেশি করে বাস্তব। ফলে জোটের চাল-চরিত্র-চেহারা সবই বদলে গেছে ও যাচ্ছে।

ভারত ও সার্ক

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সমন্বয় ও সংহতি বাড়াবার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল সার্ক। বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর। সার্কের সদস্য দেশগুলির মধ্যে ভারত শুধু যে সবচেয়ে বড় দেশ তা-ই নয়, তাদের প্রতাপও বেশি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আদর্শ বলা যায় না। কারণ, বারবার তুলনায় ছোট দেশগুলির সঙ্গে দাদাগিরির অভিযোগ উঠেছে ভারতের বিরুদ্ধে।

২০১৪ সালের পর থেকে সার্কের আর কোনো বৈঠক হয়নি। তার প্রধান কারণ, ভারত-পকিস্তান সম্পর্ক। ২০১৬ সালে সার্কের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে। ভারত বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে বৈঠকই হয়নি। তারপর পাঠানকোট এবং উরিতে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়। ভারতের অভিযোগ ছিল, পাকিস্তান এই সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য ও সমর্থন করছে। এই ভারত-পাক বিরোধের জেরে সার্ক বৈঠকও আর হয়নি। কিছুদিন আগে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়ে দিয়েছেন, পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই সার্ক বৈঠকের সম্ভাবনাও নেই।

জাতিসংঘে তা-ও নিয়মিত বৈঠক হয়। নিরাপত্তা পরিষদে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। শেষপর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে কেউ ভেটো দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না, সেটা ঠিক। কিন্তু সার্কের ক্ষেত্রে তো বৈঠকই আর হয় না।

অর্থাৎ, সার্ক এখন গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। কবে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি হবে. কবে সার্কের বৈঠক আবার হবে, কবে সেই বৈঠক থেকে কিছু ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সেই সব প্রশ্নের জবাব এখন ভবিষ্যতের গর্ভে। সেই আশা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। আর এটুকু বলাই যায় সার্ককে আর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি এখন দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে তাকাতে চান।

সাফটা ও আশিয়ান

সার্ক যে কারণে ব্যর্থ হয়েছে, সাফটাও সেই কারণে পুরোপুরি সাফল্যের মুখ দেখেনি। সাফটা হলো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি। ২০০৪ সালের এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ২০১৬-র মধ্যে সদস্য দেশগুলির মধ্যে আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক বসানো হবে না। সময়সীমা ছয় বছর অতিক্রান্ত। এখনো সাফটার দেশগুলির মধ্যে বিনা শুল্কে আমদানি-রপ্তানি হয় না। বাণিজ্য বাড়াবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল যাকে বিবিআইএন বলে তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তুলনায় ভালো। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ভারত অথবা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মধ্যে পরিকাঠামো ও যোগায়োগ ব্যবস্থা তুলনায় অনেক খারাপ। যে কারণে সার্ক ব্যর্থ, সেই কারণের ছায়াপাত সাফটাতেও ঘটবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

আসিয়ান হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংগঠন। তাই ভারত তার ডায়লগ পার্টনার হয়েছে, সামিট পার্টনারও হয়েছে। আশিয়ানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো, ভারত লুক ইস্ট ও অ্য়াক্ট ইস্ট নীতি নিয়ে চলে, এ সবই ভালো কথা, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও বাস্তব, ভারত আশিয়ানের মূল সদস্য দেশ নয়। আর এখন মুক্তবাণিজ্যের দুনিয়ায় এই রকমের জোটের গুরুত্ব থাকলেও তা অপরিসীম এমনও নয়।

চীনকে ঠেকাতে কোয়াড

কোয়াড হলো চার দেশের জোট। অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত। এই চার দেশের একটা সাধারণ উদ্বেগ রয়েছে। সেটা হলো চীনকে নিয়ে। চীন যেভাবে বড় বিশ্বশক্তি হয়ে উঠছে, দক্ষিণ চীন সাগর শাসন করতে চাইছে, আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক শক্তি হিসাবে অ্যামেরিকাকে প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে তাতে অশণি সঙ্কেত দেখছে এই চার দেশ। আর ভারতের বাড়তি উদ্বেগ হলো, চীন তাদের প্রতিবেশী এবং ইতিমধ্যে একবার যুদ্ধ ও বহুবার সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখে কী হয়েছে, তা পুরো বিশ্ব দেখেছে।

চীন যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, তাই ভারত আরো উদ্বিগ্ন। তাই চীনকে ঠেকানোর জন্য তারা কোয়াডে গিয়েছে। এখন অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের বিষয়টি পিছনের সারিতে চলে গেছে। তবে কোয়াড করে কতটা চীনকে ঠেকানো যাবে, এই চার দেশের স্বার্থ এক হবে কিনা, সেই সব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন রয়েছে।  কোয়াড সবে শুরু হয়েছে। ফলে কিছুদিন না গেলে, বোঝা যাবে না, এই জোটের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হবে, নাকি এই জোট কিছু করে দেখাতে পারবে।

জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য হওয়ার স্বপ্ন

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য। তারা যে কোনো প্রস্তাবে ভেটো দিতে পারে। আর মতৈক্য না হলে প্রস্তাব নিতে পারে না নিরাপত্তা পরিষদ। ভারতের দীর্ঘদিনের আশা, তারা নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের স্বীকৃতি পাবে। তাদের কাছেও ভেটো দেয়ার অধিকার থাকবে।  অর্থাৎ, তারাও যে কোনো প্রস্তাব খারিজ করার অধিকার পাবে। সেই সঙ্গে ভারতের বাড়তি সম্মান ও ক্ষমতালাভ হবে।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

ভারতকে চাপে রাখতে পাকিস্তান এখন প্রায়ই বিশেষ করে কাশ্মীর প্রসঙ্গ জাতিসংঘের বিভিন্ন বৈঠকে তোলে। সম্প্রতি বেশ কয়েকবার এই ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই কূটনৈতিক দিক থেকে সক্রিয় হয়ে ভারত এর মোকাবিলা করেছে। জাতিসংঘে ভারতকে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।

ভারত এখন নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত এই সদস্য থাকবে। কিন্তু ভারতের লক্ষ্য হলো, নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হওয়া। ইতিমধ্য়ে অ্যামেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তারাজ্য, এমনকী চীনের সঙ্গেও কথা বলেছে ভারত। কয়েক বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ভারত সফরে এসেছিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী মোদী তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তখনো লাদাখ-কাণ্ড হয়নি, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এতটা খারাপও হয়নি। কিন্তু সম্পর্ক ভালো হোক বা খারাপ, চীন এখনো পর্যন্ত ভারতকে স্থায়ী সদস্য হিসাবে মেনে নিতে রাজি হয়নি। নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতে হবে এমন কোনো সমস্যাও নেই।

এরপরেও হয়ত ভারত বারবার দাবি জানাবে, স্থায়ী সদস্য হওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ, আশায় বাঁচে চাষা। তবে ভেটো দেয়ার অধিকার পেলেও বা কি না পেলেও বা কী। জাতিসংঘই তো ক্রমশ প্রভাবপ্রতিপত্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারছে না। নিতে গেলেই ভোটে ভেটো দিচ্ছে পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশের মধ্যে একটা। রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলা জাতিসংঘ ঠেকাতে পারেনি। ইউক্রেন থেকে রাশিয়াকে সেনা প্রত্যাহারে তারা বাধ্য করতে পারেনি। এর আগে ন্যাটোকে রাশিয়ার দরজায় পৌঁছে যাওয়ার কৌশলও তারা বানচাল করতে পারেনি। ফলে জাতিসংঘ থেকে যাবে তার মতো। ভেটো-ব্যবস্থার দৌলতে ক্রমশ গুরুত্বহীন হবে তারা। ভারতও ভেটোর ক্ষমতা হাতে পেতে চায়। আর তারা যাতে এই ক্ষমতা না পায়, তা নিশ্চিত করতে চীনের কাছে ভেটো-ক্ষমতা তো আছেই।

তাই ভারতের আশা কবে পূর্ণ হবে, আদৌ পূর্ণ হবে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। তার আগে শুধু এটুকু বলা যায়, আন্তর্জাতিক জোট-কাহিনি বদলাতে থাকবে। তৈরি হবে নতুন জোট, সংগঠন, সেখানে ভারত কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, তা নির্ভর করবে, কতটা দ্রুত সে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হবে তার উপর।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য