‘জনগণকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট করলে নির্বাচন সহজ হবে’
২৬ মে ২০২৩ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি সেখানে কতটা গুরুত্ব পেতে পারে? আইএমএফের শর্ত মেনে বর্তমান অর্থমন্ত্রী কতটা নির্বাচনমুখি বা কল্যাণমূলক বাজেট দিতে পারবেন? বাজেটের এসব দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা৷
ডয়চে ভেলে : এবারের বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো কী?
অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা : বর্তমানে অর্থনীতিতে ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আরেকটি হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির একটা ভারসাম্য বজায় রাখা এবং কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিকে একটি ইতিবাচক দিকে নিয়ে আসা৷ এই অবস্থার মধ্যে আমাদের বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে৷ সুতরাং অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে বাজেট করতে হবে অর্থাৎ এটি মাথায় রেখে রাজস্ব আহরণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এবং খরচের অন্য দিকগুলো দেখতে হবে৷ অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বাজেটের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হল আমাদের রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি খুবই কম৷ আমরা জানি, রাজস্ব আয় এবং জিডিপির অনুপাত খুবই কম৷ সুতরাং রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের হারও বাড়াতে হবে৷
এটি বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট৷ বাজেটে কী নির্বাচন গুরুত্ব পাবে?
বাজেটে গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ জনগণ৷ মনে রাখতে হবে জনগনের জন্যই তো নির্বাচন৷ সুতরাং সেই হিসেবে যদি আমরা দেখি, জনগণ এবং নির্বাচন দু'টিই প্রাধান্য পাবে বা পাওয়া উচিৎ৷ জনগণকে প্রধান্য দিয়ে যদি আমরা একটা ইতিবাচক বাজেট প্রণয়ন করতে যাই তাহলে সেটি নির্বাচনকেও সহজ করে দেবে৷
মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজেটে কী করা উচিত?
মূল্যস্ফীতির চাপের বিষয়ে দু'টি মূল দিক৷ একটি হচ্ছে, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে পরোক্ষ কর যেগুলো রয়েছে, সেখানে কিছু সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে৷ মূসক, রেগুলেটরি ডিউটিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় যেসব পণ্য রয়েছে সেগুলো যদি কাটছাঁট করা হয়, যদিও আগেও সরকার সেটা করেছে তাহলে মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ জনগণ কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়৷ আরেকটি হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি৷ এটির কিন্তু কোনো বিকল্প নেই৷ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো, ওএমএসের মাধ্যমে যেসব পণ্য দেওয়া হয় সেটির ব্যাপকতা বাড়ালে সবাই আরেকটু স্বস্তি পেত৷
জনতুষ্টির বাজেট আর জনকল্যাণের বাজেটের মধ্যে পার্থক্য কী?
আসলে সেইভাবে কি কোনো পার্থক্য রয়েছে? জনগণ বলতে যদি আমরা দেশের আপামর জনসাধারণ সবাইকে বোঝাই তাহলে সবার কল্যাণের জন্য যে বাজেট হবে সেটা তো সবাইকে তুষ্ট করা উচিৎ বলে আমি মনে করি৷ সুতরাং জনগণ বলতে যদি আমরা সব মানুষকে বোঝাই, সব মানুষের সিংহভাগ মানুষই যদি সন্তুষ্ট থাকে বা তুষ্ট থাকে সেটাই কিন্তু জনকল্যাণের বাজেট৷
বাজেট আসলে নির্বাচনে কতোটা প্রভাব ফেলে?
বাজেট নির্বাচনে খুব বড় প্রভাব ফেলে বলে আমার মনে হয় না৷ বাংলাদেশে এখন যেভাবে বাজেট হচ্ছে, সেটি হচ্ছে মধ্যমেয়াদি একটা পরিকল্পনা৷ এটা মূলত তিন বছর মেয়াদি একটা পরিকল্পনা করা হয়৷ সেই আওতায় কিছুটা কাটছাঁট করা যায় কিন্তু ব্যাপক ধরনের পরিবর্তন সাধারণত করা হয় না বা সেটার খুব বেশি সুযোগও থাকে না৷ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মোটা দাগে যদি দু'একটা বলি, জিনিসপত্রের দাম একটু কম রাখা, সাধারণ মানুষকে একটু সন্তুষ্ট রাখা, সেখানে করের বিষয় রয়েছে, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের বিষয় রয়েছে এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে এক ধরনের স্বস্তি দেওয়া যায়৷ এটা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে যেহেতু আমরা মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে চলি ফলে ব্যাপক পরিবর্তন সেখানে হয় না৷ একটা ধারাবাহিকতাই আমরা দেখে থাকি৷
ডলার সংকট দূর করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ?
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ডলার সংকট দূর করতে হলে চাহিদা এবং জোগান এই দু'টোই মূল বিষয়৷ প্রথমত, ধীরে ধীরে বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়াতে চলে যাওয়া৷ আরেকটি বিষয় হল, আমাদের যে কয়েকটি বিনিময় হার রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে একক বিনিময় হার করা৷ এই দু'টোর বাইরে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে আমরা যতটা সমন্বয় করতে পারবো৷ এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, বিলাসবহুল পণ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ কর আরোপ করা হয়েছে৷ এটাও চিন্তা ভাবনা করে আরও কিছু করা যেতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা করতে হবে৷ খুব দ্রুত হয়ত কিছু করা সম্ভব না, কিন্তু মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের যেটা চিন্তা করতে হবে সেটা হল রপ্তানি বাড়ানোর জন্য আমাদের বহুমুখিকরণ দরকার রয়েছে৷ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও পোশাক শিল্পের ভেতরে ও বাইরে অন্যান্য জায়গায় বহুমুখিকরণ দরকার৷ এটার মাধ্যমে আমরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে একটা শক্ত জায়গায় আসতে পারি৷
এটার পাশাপাশি খুবই জরুরি আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের আয়৷ প্রবাসী শ্রমিকদের আয় বাড়ানোর জন্য কিন্তু বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে৷ এখানে দুটো বিষয় মাথায় রাখতে হবে৷ প্রথমত হুন্ডি৷ অবৈধ পথে আসার যে প্রবণতা, সেটা নিরুৎসাহিত করাটা খুবই জরুরি৷ যতদিন পর্যন্ত আমি নিরুৎসাহিত করতে না পারব ততদিন পর্যন্ত এটা সঠিক পথে আনা কঠিন৷ আমাদের প্রবাসী যারা রয়েছেন আমি তাদের দোষ দেব না, কারণ তারা যেখানে বেশি বিনিময় হার পাবেন সেখানেই লেনদেন করবেন৷ সাধারণত অবৈধপথে বেশি বিনিময় হার দেওয়া হয় এবং খুব দ্রুত দেওয়া হয়৷ আর দ্বিতীয় যেটা হল, বৈধ পথে আমরা তাদের কিভাবে উৎসাহিত করব৷ মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এখানে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে৷ একজন প্রবাসী যখন অর্থ পাঠাচ্ছেন সেটা দ্রুত তার পরিবারের হাতে পৌঁছে দিতে হবে৷ এই সেবাটা তার একেবারে কাছে নিয়ে আসতে হবে৷ ডলার সংকটের ক্ষেত্রে শেষে যেটা বলব, আমাদের সেবাখাত যেটা রয়েছে সেখান থেকে একটা বড় অংকের ডলার বাইরে চলে যেতে পারে৷ সেই সেবাগুলো কীভাবে দেশের ভেতরে দেওয়া যায় সেই জিনিসগুলো দেখার দরকার রয়েছে৷
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে শর্ত মানতে হয়৷ এই শর্ত মেনে সরকার কী নির্বাচনি বাজেট বা কল্যাণমূলক বাজেট দিতে পারবে?
আমি যেটা মনে করি, আইএমএফের শর্তগুলোর দিকে যদি তাকান তাহলে দেখবেন বেশিরভাগ শর্ত যদি বাস্তবায়ন করা হয় সেটাকে বেশিরভাগ জনগণ ইতিবাচক হিসেবে দেখবে৷ রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে যদি বড় ধরনের সংস্কার করা হয়, এই সংস্কার আমি মূলত বলব যে, ব্যক্তিখাতে আয়করের উপরে গুরুত্ব আমাদের বাড়াতে হবে৷ আর্থিক খাতের যে সংস্কার, সেটার প্রস্তাবনাও আইএমএফ দিয়েছে৷ সেখানে খেলাপি ঋণসহ আরো কিছু বিষয় রয়েছে৷ এই জায়গাগুলোতে যদি আমরা সংস্কার করতে পারি তাহলে জনগণ সেটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে৷ তবে ভর্তুকির বিষয়টা নির্বাচনের বছর বলে শুধু না সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কী ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার সেটা সাবধানে করতে হবে৷ খাত ভিত্তিক করতে হবে৷ সেখানে কৃষি, জ্বালানির ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে৷ ভর্তুকির বিষয়ে কিছু চিন্তাভাবনার বিষয় আছে, নির্দিষ্ট করার বিষয় আছে৷ কিন্তু সার্বিকভাবে আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদই একমত পোষণ করেছেন৷ গুরুত্বপূর্ণ যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে সেগুলো জনগণের জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে৷