নতুন নাগরিক
৩১ জুলাই ২০১৫ছিটমহল নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন, এ রকম একজন চিত্রপরিচালক একবার বলেছিলেন, ধরে নেওয়া যাক এমন একটা জায়গা, যেখানে পড়াশোনার জন্য স্কুল নেই, অসুস্থ হলে চিকিতসার জন্য হাসপাতাল নেই, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হলে থানা-পুলিস নেই, এমনকি রোজকার বেঁচে থাকার জন্যে যে বাজারহাট, দোকান দরকার হয়, সেটুকু পর্যন্ত নেই৷ চাল কিনতেও যেতে হয় সীমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশে৷ যেহেতু ‘নেই রাজ্যের' বাসিন্দা, পাসপোর্ট-ভিসার ব্যাপার নেই তাঁদের৷ এমনকি নাগরিকত্বও নেই না মানুষগুলোর৷ ফলে পুরো বেঁচে থাকাটাই তাঁদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভরশীল৷ রক্ষীরা যখন ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে হেনস্থা করে৷ প্রতিবাদ করলে আটকে রেখে অত্যাচার করে৷ সামান্য এক বস্তা চাল আনার অনুমতি দিতে হলেও ঘুস চায় তারা৷ আর না দিলে হাত মুচড়ে কেড়ে নেয় কষ্টের চাল৷
‘‘আমরা, যাঁরা শহরে-গ্রামে থাকি, তাঁরা ঘোর দুঃস্বপ্নেও চিন্তা করতে পারব না এমন একটা দুঃসহ জীবনের কথা৷ কিন্তু ছিটমহলের মানুষগুলোর কোনো উপায় নেই৷ নেহাত বাধ্য হয়েই, কার্যত ওই কুকুর-বেড়ালের জীবন ওঁদের'', বলেছিলেন সেই চিত্রপরিচালক৷ তাই ছিটমহলের অবলুপ্তি মানে সেই মানুষগুলোর জন্যে একটা ভদ্র-সভ্য জীবন বাঁচার সুযোগ৷ ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল হস্তান্তরের পর, ওঁরা কে কোন দেশে থাকতে চান, তার সমীক্ষাও করা হয়েছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা সবাই ভারতেই থাকতে চান৷ আর বাংলাদেশের ছিটমহল থেকে ৯৭৯ জন মানুষ মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে চলে আসতে চান৷ এই যাঁরা চলে আসবেন, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ ধর্মত হিন্দু৷ বাকিরা মুসলমান৷
এই তথ্যের মধ্যে কিন্তু কোনো চমক নেই৷ কাজের সুযোগ যেদিকে বেশি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চিরকাল সেদিকেই থাকতে চেয়েছেন৷ ঠিক যেভাবে গ্রাম-মফস্বল থেকে শহরে, ছোট শহর থেকে আরও বড় শহরে চলে আসে মানুষ৷ বড় জায়গা মানে বেশি কাজ, জীবনধারণের সুযোগ আরও বেড়ে যাওয়া – হিসেবটা এতটাই সহজ-সরল৷ এর মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ, হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের ভূমিকা খুব কম৷ ধরা যাক যে মুসলিম পরিবারগুলো ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহল ছেড়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে চলে যেতে চায়, তারা কি দেশকে ভালোবাসে না? কথায় বলে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম৷ আগে তো পেট, তার পরে তো দেশ এবং অন্যান্য সব কিছু৷ যদি অন্নের সংস্থানই না হয়, জীবিকার নিশ্চয়তা যদি না থাকে, তা হলে কোন দেশের নাগরিক হলাম, তা দিয়ে কী হবে?
অবশ্য বিচ্ছিন্ন দু-একটি অভিযোগও শোনা যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহলের কিছু বাসিন্দাকে নাকি ভারতে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে৷ তাদের নাকি জোর করে বাংলাদেশে রেখে দেওয়া হচ্ছে৷ যেহেতু এখনই এ খবর যাচাই করার কোনো উপায় নেই, যদি এমন কিছু ঘটছে বলে মেনে নিতেও হয়, তা হলেও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়৷ প্রথমত, এমন বাধ্যতামূলক নাগরিকত্ব আদৌ কেউ মেনে নেবে কিনা, নিলেও কতদিন এভাবে জোর করে তাদের আটকে রাখা যাবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন৷
দ্বিতীয় প্রশ্নটা তার থেকেও বড়৷ ছিটমহল এত বছর ধরে অপাংক্তেয় থেকে গেলেও, ৩১শে জুলাইয়ের পর থেকে আর থাকবে না৷ সীমান্ত পাহারা ছাড়া প্রশাসনিক নজর আগে যেমন এই এলাকায় একেবারেই ছিল না, ভবিষ্যতে তেমনটা আর হবে না৷ বরং উল্টোটা হবে৷ ছিটমহল বিনিময়ের পর দু'দেশের সরকারই এই এলাকার পুনর্গঠন এবং উন্নয়নে যত্নবান হবে৷ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে৷ ফলে জোরজুলুম বেশিদিন চলবে না৷
তাছাড়া, ছিটমহলের অবলুপ্তি ঘটলেও নাগরিক বিনিময়ের প্রক্রিয়া এখনই শেষ হচ্ছে না৷ এখানকার বাসিন্দাদের ঠাঁইবদল চলবে এই বছরের শেষ পর্যন্ত৷ সেক্ষেত্রে ইচ্ছুকদের জোর করে তাদের অপছন্দের দেশে আটকে রাখা নেহাত সহজ হবে না৷
ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে ছিটমহলগুলি থেকে যাওয়াটা এক ধরনের রাজনৈতিক বাধ্যতা ছিল৷ ঠিক কেমনই এই সব ছিটমহলের অবলোপ এক ঐতিহাসিক অবশ্যম্ভাবিতা বলে আজ মনে হচ্ছো৷ এর পর দুই দেশের কাছেই আর একটা কর্তব্য পালন করাই বাকি থাকে৷ এখানকার বাসিন্দাদের নিরপেক্ষ এবং সামগ্রিক উন্নয়ন৷ তবে সেটা কতদূর হয়, সময়ই সেই কথা বলবে৷