জার্মানির সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ'র ভরাডুবি হয়েছে৷ দলটির চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী আরমিন লাশেট জনগণের পর্যাপ্ত সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হন৷ ফলে নির্বাচন পরবর্তী জোট গড়তে ছোট দলগুলোর কাছে সিডিইউ'র চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডির গুরুত্ব বেড়ে যায়৷
লাশেট সহজে পরাজয় মেনে নেয়ার পক্ষে ছিলেন না৷ বরং নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও তার মাঝে ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষীণ বাসনা দেখা গিয়েছিল৷ তিনি আশা করেছিলেন, এসপিডি হয়ত মুক্ত গণতন্ত্রী দল এফডিপি আর পরিবেশবান্ধব সবুজ দলের সঙ্গে জোট গড়তে পারবে না৷ কারণ এই দলগুলোর নীতিগত কিছু অবস্থান সাংঘর্ষিক৷ বিশেষ করে এফডিপি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার দল হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে সবুজ দল চায় তরুণ প্রজন্মকে সামনে নিয়ে পরিবেশরক্ষায় গুরুত্ব দিতে৷ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
অতীতে এই দুই দল মিলতে পারেনি বলে সম্ভাব্য জোট ভেঙে যাওয়ার নজির আছে৷ ফলে এবার কী হয় সেটা নিয়েও অনেকের আগ্রহ ছিল৷
এক সম্মেলনে দুই নেতা
এদিকে, টানা ষোল বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ম্যার্কেল সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর হয়ে যান ‘কেয়ারটেকার চ্যান্সেলর’৷ অর্থাৎ, পরবর্তী চ্যান্সেলর ক্ষমতা গ্রহণ না করা অবধি দায়িত্বে থাকবেন তিনি৷ চলতি মাসে জোট সরকার চূড়ান্ত করতে সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় এসপিডি, এফডিপি ও সবুজ দল৷ ফলে গত বুধবার এসপিডি দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী ওলাফ শলৎস চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নেন৷ শেষ হয় ম্যার্কেলের কার্যকাল৷
তো এই ম্যার্কেল গত অক্টোবরে ইটালির রাজধানী রোমে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে গেলেন শলৎসকে৷ তখনো শলৎসের জোট চূড়ান্ত হয়নি৷ ম্যার্কেলের নিজের দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী লাশেটও আশা ছাড়েননি৷
তারপরও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের চমৎকার উদাহরণ তৈরি করে ম্যার্কেল নিজের সঙ্গে শলৎসকে নিয়ে যান জি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে৷ তিনি সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে শলৎসই হতে যাচ্ছেন তার উত্তরসূরী৷ তাই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন সম্মেলনে৷
অতীতের শিক্ষা, গণতন্ত্রই শক্তি
জার্মানির নির্মম অতীত ইতিহাস রয়েছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ ইহুদি হত্যা করেছে নাৎসিরা৷ সেসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধে মারা গেছেন কোটি কোটি মানুষ৷
জার্মানি সেই যুদ্ধের দায় স্বীকার করেছে অকপটে৷ তবে ক্ষমা চেয়ে, ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজেদের ভুল শুধরে আবার সঠিক পথে ফিরে যেতে দেশটি খুব বেশি সময় নেয়নি৷ বিশ্বের বুকে গত কয়েক দশকে দেশটি আবারো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্র৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানি গণতন্ত্রকে এতটাই শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে যে রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থার সর্বত্র জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে৷
এই দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত মূলধারার দলগুলো মধ্যে চিরশত্রুতা বলে কিছু নেই৷ দেশটির সবচেয়ে বড় দুটি দল হচ্ছে মধ্য ডানপন্থি সিডিইউ এবং মধ্য বামপন্থি এসপিডি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই দল দুটি কখনো সরকারে এবং বিরোধী দলে থেকে যেমন সংসদে থেকেছে, তেমনি একটি বড় সময় দুটো দল মিলে জোট গড়েও জার্মানি পরিচালনা করেছে৷
আবার ছোট দলগুলোর কথা যদি ধরেন - যে এফডিপি ও গ্রিন চার বছর আগেও জোট গড়তে ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের দূরত্ব ঘোচাতে না পেরে তারাই আবার চার বছর পর নিজেদের মধ্যকার বিভেদ মিটিয়ে এসপিডির সঙ্গে জোট গড়ে জার্মানি শাসনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে৷
ইউরোপের দেশটির রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে চিরশত্রুতা বলে আসলে দলগুলোর মধ্যে কোনো ব্যাপার নেই৷ তাই তাদের নেতাদের বা সমর্থকদের সারাক্ষণ প্রতিপক্ষের কুৎসা রটনা করে কিংবা নোংরা, কুরুচিপূর্ণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য করে শত্রুতা জিইয়ে রাখার দরকার হয় না৷
উগ্র ডানপন্থিদের সঙ্গে জোট নয়
জাতীয় স্বার্থে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য বেশ মজবুত৷ জার্মানিতে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা উগ্র ডানপন্থি ‘অল্টারনেটিভ ফর ডয়চেল্যান্ড (এএফডি)’ দলের কথাই ধরুন৷ গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এই দলটি কোনো নিষিদ্ধ ঘোষিত দল নয়৷ কিন্তু সেটির নীতিগত অবস্থান কিছু ক্ষেত্রে জার্মানি যে অতীতের জন্য অনুতপ্ত সেই অতীতের রাজনৈতিক নীতির সঙ্গে মিলে যায়৷
তাই এই দলটির সঙ্গে জোট না গড়ার বিষয়ে শুরু থেকেই একমত সিডিইউ, এসপিডি, এফডিপি বা সবুজ দল৷ ফলে দশ শতাংশের বেশি মানুষের ভোট পাওয়া এএফডি সংসদে থাকলেও তাদের কোনো ক্ষমতা নেই৷
কেননা, কেউই তাদেরকে নিয়ে জোট গড়ে রাষ্ট্রীয় নীতি বদলানোর ক্ষমতা তাদের দেবে না৷ বরং কেন মানুষ এএফডিকে ভোট দিচ্ছে সেটা অনুধাবন করে সুযোগ থাকলে তাদের নিজেদের দলে ফিরিয়ে আনা বা কঠোর হস্তে উগ্র ডানপন্থাকে দমনের দিকেই যাচ্ছে অন্য দলগুলোর জোট৷
রাজনীতি যখন প্রকৃত অর্থে দেশ ও জনগণের স্বার্থে হয় তখন এসব বিষয় সহজেই সম্ভব হয়৷ তাই, এখনো যারা রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষের প্রতি চির শত্রুতা লালন করেন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে যে-কোনো দলের সঙ্গেই জোট গড়তে চান, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত৷ নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির স্বার্থ দেখুন৷ সবাই মিলে এমন এক গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলুন যেখানে জনগণের রায়ই শেষ কথা৷