তিনে মিলে মৌসুমী
১৬ নভেম্বর ২০১১পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে বড় হয়ে উঠেছেন তিনি৷ মৌসুমী মুখার্জি৷ পেশায় ডাক্তার এক মামা আর এক মাসী বা খালাকে দেখে ছেলেবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার শখ ছিল তাঁর৷ স্কুলজীবনে দারুণ রেজাল্ট হল, ডাক্তারিতে সুযোগ পেলেন, কলকাতায় চলে আসা তারপরে৷ চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করলেন৷ তখন থেকেই সিদ্ধান্ত, পেশায় পা দেবেন বটে, তবে করতে চান এমন কাজ, যাতে উপার্জন নয়, মুখ্য হবে মানবিকতার সেবা করা৷ সেই নেশা থেকেই সরকারি চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করতে চাইলেন৷ যাতে সাধারণ মানুষের সংশ্রব সবসময়েই থাকে৷ সেই পেশাতেই আজও নিয়োজিত মৌসুমী৷
এখন একইসঙ্গে দু'টো পেশা সামলাচ্ছেন মৌসুমী৷ সরকারি চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন দিনের আধখানা সময়৷ বাকিটা স্বাস্থ্য বিমা বিষয়ক একটি সংস্থার সমগ্র পূর্ব ভারতের কর্ণধার হিসেবে কাজ করেন মৌসুমী৷ নিজের পেশাকে ভালোবাসেন শুধু তাই নয়, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে যায় তাঁর সবক্ষেত্রেই৷ যেমন গল্প করে বললেন এক বৃদ্ধের কথা৷ দীর্ঘদিন তিনি মৌসুমীর কাছে চিকিৎসা করাচ্ছেন৷ গত একবছর ধরে যিনি ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছেন প্রতিদিন একটু একটু করে৷ প্রায় নব্বই শতাংশ দেখতে পাননা এখন আর৷ মৌসুমীর কাছে দেখাতে এসে পুজোর মুখে হাতের ব্যাগ থেকে কয়েকটি গ্ল্যাডিওলাস ফুলের বাল্ব বের করেন বৃদ্ধ মানুষটি৷ বলেন, আমার বিশ্বাস, আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না৷ এগুলো আপনাকে দিতে চাই৷ আমার সঙ্গে যখন আর দেখা হবেনা, আপনার বাগানে এগুলো পুঁতে দেবেন৷ এভাবেই থেকে যাব আমি আপনাদের মধ্যে৷
এভাবেই রোগী আর রোগিনীদের নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেন মৌসুমী৷ ব্যক্তিজীবনে রয়েছে স্বামী, পুত্র এবং শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে জমজমাট কাজকম্মের সংসার৷ সেখানেও হাজারটা দায়িত্ব পালন করেই নিজের পেশাকে সামলান তিনি৷ মনে করেন, এভাবে চলতে গেলে যথেষ্ট ধৈর্য এবং সবদিক বজায় রাখার মত ঠান্ডা মাথার প্রয়োজন হয়৷ সেই ভারসাম্য বজায় রাখাটা শিখতে হয়েছে নিজেকেই৷ মৌসুমী মনে করেন, প্রতিটি নারীই এই দুই ভূমিকা বজায় রাখার মত প্রতিভাশালিনী৷
পরের প্রজন্মের যেসব মেয়েরা এই চিকিৎসকের পেশায় আসবেন, তাঁদের জন্য পরামর্শ চাইলে মৌসুমী বলছেন, এই পেশাটা আজকাল শুধুই বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে৷ অথচ আদতে এ হল এমন এক পেশা, যা কিনা মানবিকতায় আদ্যোপান্ত মোড়া৷ তাই পরবর্তীতে যে সব মেয়েরা ডাক্তার হতে চাইবেন, তাঁরা যদি সেটুকু মনে রাখেন, তাতে ভালোই হবে, মন্দ নয়৷ বস্তুত চিকিৎসাকে তো বলাই হয়ে থাকে মহান একটি ব্রত৷ সে ব্রতপালন করতে গেলে বাণিজ্যিক দিকটুকুকে ছেঁটে ফেলাই বিধেয়৷ তাই মৌসুমীর এই বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে মনে রাখার মত৷
সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার সময় এই মানবিক চিকিৎসক ছিলেন পুরুলিয়ার একটি গ্রামে৷ সেখানে সেদিন প্রবল ঘনমেঘ আকাশজুড়ে৷ ঘন ঘন বজ্রগর্জন৷ ডয়চে ভেলের শ্রোতাদের জন্য মৌসুমী তাই গেয়ে শুনিয়ে দিলেন সেই পরিবেশের সঙ্গীত, নিজের পছন্দমত বর্ষার রাগিনী মলহারের একটি বন্দিশ৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ