‘চাকরির ভয়ে নারীরা যৌন হয়রানির কথা বলেন না’
৫ মার্চ ২০১৯ডয়চে ভেলে : কর্মক্ষেত্রে নারীরা কতটা অধিকার ভোগ করছে বাংলাদেশে?
ব্যারিস্টার সারা হোসেন: এক অর্থে অধিকার ভোগ করছে৷ কারণ কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে৷ কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ গার্মেন্টস সেক্টরে তো অনেক নারী কাজ করছেন৷ সরকারি চাকরিতেও আগের চেয়ে নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি দেখা যায়৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য জায়গায়ও নারীদের সুযোগ বাড়ছে৷ পাশাপাশি নানান ধরনের সমস্যায়ও তারা পড়ছেন৷ যেমন ধরেন, হয়রানি একটা বড় সমস্যা৷ পাশাপাশি যৌন হয়রানি যদি ধরেন, এটা নিরোধ করতে নানা ধরনের আইন আছে৷ হাইকোর্টের রায়ও আছে৷ কিন্তু রাষ্ট্র বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সেটা নেওয়া হচ্ছে না৷ এই ধরনের হয়রানির শিকার হলে অনেকেই বলতে পারে না৷ তার চাকরির ভয় থাকে বা তাকে নিয়ে কথা বলাবলির একটা ভয় কাজ করে৷ পাশাপাশি কিছু সুবিধা নারীদের পাওয়ার কথা, যেমন ধরেন মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়৷ আইনে ভালোভাবে থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটার বাস্তবায়ন হচ্ছে না৷ আরেকটা সমস্যা হলো- বেসরকারি চাকরি যারা করেন তাদের অনেক রাত পর্যন্ত অফিস করতে হয় বা ভোরে অফিসে যেতে হয়৷ সেক্ষেত্রে যানবাহনের যে অবস্থা সেখানে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়৷ অফিসে যে ধরনের সমস্যায় পড়েন, রাস্তায়ও তাদের একই ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়৷ কেউ কেউ হয়ত প্রতিবাদ করেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নীরবে সবকিছু সহ্য করতে হয়৷
অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে কোন জায়গায় এখনো ঘাটতি আছে বলে মনে করেন আপনি?
আমাদের দেশে আইনকানুন যা আছে, তা হয়তো আরো ঠিক করা সম্ভব৷ প্রক্রিয়াগতভাবেও ঠিক করা সম্ভব৷ আইন যা আছে তার যদি সঠিক প্রয়োগ হতো তাহলেও অনেক সমস্যা কমে যেত৷ আইনকানুনের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন৷ যেটা বলছিলাম, যৌন হয়রানি৷ সেখানে আদালতের একটা রায় আছে৷ সেখানে বলা আছে, একটা ঘটনা ঘটলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না, যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না৷ আইনে কিন্তু বলা আছে, আপনি একজন পুরুষ হলে কর্মক্ষেত্রে আপনি একজন নারীর সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করবেন, কী করলে অশ্রদ্ধা হিসেবে গণ্য হবে তাও বলা আছে৷ এগুলো কিন্তু মানা হচ্ছে না৷
নারী কতটা নিরাপদ কর্মক্ষেত্রে?
এটা আসলে নির্ভর করছে আপনি কোথায় কাজ করছেন৷ যেমন আপনার পাশে যে নারী কাজ করছেন তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কাজ করছেন৷ আমি কাজ করছি আদালতে৷ আবার লক্ষ লক্ষ নারী কাজ করছেন গার্মেন্টসে৷ অনেকে কাজ করছেন গৃহকর্মী হিসেবে৷ অনেকে রাস্তায় পানের দোকানে কাজ করছেন, অনেকে ইট ভাঙছেন৷ একেক জন একেক জায়গায় কাজ করছেন৷ অনেকের জন্য কিন্তু কোনো আইনই নেই৷ যে রাস্তায় কাজ করছে তার জন্য কোনো আইন নেই৷ আবার যে কারখানায় কাজ করছে তার জন্য শ্রম আইন আছে৷ আমরা যারা আদালতে কাজ করছি, তাদের জন্য প্রশাসনিক রেজুলেশন আছে, বার কাউন্সিল আছে৷ এখন সবাইকে আইনের মধ্যে আমরা আনতে পারছি না৷ আমি একটা উদাহরণ দেই৷ উচ্চ আদালতে আগে নারীদের জন্য একটা মাত্র ওয়াশরুম ছিল৷ এখন কয়েকটা হচ্ছে৷ অথচ প্রতিটি ফ্লোরে পুরুষদের জন্য চারটি করে ওয়াশরুম আছে৷ এখন অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে৷ এখন তো নারীরা বেশি করে কাজে আসছেন, তাদের জন্য কর্মক্ষেত্র কতটা উপযুক্ত সেটা এখন দেখতে হবে৷
সব কাজে কি এখনো নারীর সুযোগ অবারিত?
সব জায়গায় এই সুযোগ নেই৷ যেমন ধরেন আইনে বলা আছে, রাতের বেলায় কারখানায় নারীরা কাজ করতে পারবেন না৷ এখন কোনো নারী যদি বেশি আয় করতে চান তাহলে তাকে রাতে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে৷ এর জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে, কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে৷ এটা না থাকার কারণে অনেকেই ইচ্ছে থাকলেও এই সুযোগটা নিতে পারছেন না৷ আগের থেকে অনেক উন্মুক্ত হয়েছে৷ তবে এখনো অনেক বাধা নিষেধ আছে৷
কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই নারীদের যৌন হয়রানির কথা শোনা যায়৷ এটা দূর করতে আপনার পরামর্শ কি?
সুপ্রিমকোর্টের একটা রায় আছে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটা সেল থাকতে হবে৷ এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এসব কমিটিতে অবশ্যই নারীদের সংখ্যা বেশি থাকতে হবে৷ সেখানে যে কেউ অভিযোগ করতে পারবে৷ কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই সেটার বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ বেশ কয়েকবছর আগে মহিলা আইনজীবী সমিতি এই রায়টি পেয়েছিল৷ আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল এখানে দু'টি কথা বলার৷ অনেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে৷ অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যৌন হয়রানির নীতিমালা করেছে৷ কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি৷ একটা ভালো দিক, কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে৷ তারা এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন৷ এই উদ্যোগগুলো আরো বেশি জোরালো করা দরকার৷ আমার মনে হয়, কেন্দ্রীয়ভাবে এটা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন৷ আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, যে প্রতিষ্ঠান থেকে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হোক, বা ব্যবস্থা নেওয়া হোক প্রতিবেদনগুলো সংসদে যেতে হবে৷ কিন্তু সংসদে কোনো প্রতিবেদন যাচ্ছে বলে আমরা জানি না৷ এটা নিয়ে কোনো পর্যালোচনাও আমরা শুনিনি৷
সব নারী কি নায্য মজুরি পাচ্ছেন?
এটা একটা বড় সমস্যা৷ অনেক নারীই নায্য মজুরি পাচ্ছেন না৷ অনেক সময় নারী-পুরুষ সমান কাজ করলেও নারীকে কম মজুরি দেওয়া হচ্ছে৷ এটা বিভিন্ন পেশায় যেমন দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রেও দেখা যায়৷ এখনও এটা একটা বড় সমস্যা৷
নারীদের ক্ষেত্রে মূল বৈষম্যের জায়গা কোনটি?
কিছু কিছু জায়গায় ধরেন নারীদের একেবারেই কোনো অংশগ্রহণ নেই৷ যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নারীদের কোনো অংশগ্রহণ নেই৷ এটা একটা বড় সমস্যা৷ এর বাইরে বিয়ে রেজিষ্ট্রি৷ সেখানে কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা কোনো নারীকে এই কাজে দেখিনি৷ অন্যান্য দেশে নারীরা এই কাজ করেন৷ কিছু কিছু জায়গা আছে, আইনে কিছু না বলা হলেও বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সেই কাজ নারীরা করতে পারবেন না৷ আরেকটা জিনিস হলো, একজন নারী চাকরিজীবী হলেও পুরো পরিবারের বিষয়টা তার উপর বর্তাচ্ছে৷ যেমন ধরেন সন্তান লালনপালন, বাড়িঘর পরিচালনা করা, পরিবারের সদস্যদের দেখা, সবকিছু কিন্তু নারীকেই দেখতে হয়৷ এখন পুরুষদেরও কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত সন্তান লালনপালন বা ঘর সংসারের৷ তাহলে যৌথ দায়িত্ব যৌথভাবেই পালন করা হবে৷
নারীর মূল বৈষম্যের জায়গা কোনটি বলে মনে হয়? লিখুন নীচের ঘরে৷