কী সেবা দেবে এই পুলিশ?
১৫ আগস্ট ২০১৬বিজ্ঞাপন
‘‘যারা পয়সা দিয়ে চাকরিতে আসে, তারা তো প্রথমেই সেই পয়সা ওঠানোর চেষ্টা করবে৷ তারা তো সেবা দেবে না৷ তাই বিধি মোতাবেক নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত নিয়োগ হতে হবে৷’’ ডয়চে ভেলেকে বললেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা৷
ডয়চে ভেলে: পুলিশ বাহিনীর জনবল নিয়মিত বাড়ছে, পুলিশকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কী করা উচিত?
নুরুল হুদা: দেখতে হবে নিয়োগটা যেন যথাযথভাবে, আইনসম্মতভাবে এবং বিধিসম্মতভাবে হয়৷ এর সঙ্গে তাদের প্রশিক্ষণও যথাযথভাবে হতে হবে৷ পুলিশের কাজটাকে বিনিয়োগ মনে করতে হবে৷ আর নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদায়ন হতে হবে বিধি মোতাবেক৷
গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর ব্যাপারে আপনার কোনো পরামর্শ?
গোয়েন্দা কার্যক্রম তো বাড়ানোর কিছু নেই৷ এটা তো সব সময়ই দরকার হয়৷ সেটা যেন গোপনে হয়, সেজন্য নিরবে কাজ করতে হবে এবং তথ্যের উপরে বেশি জোর দিতে হবে যাতে বেশিরভাগ ঘটনাকে প্রতিরোধ করা যায়৷ প্রতিকার নয়, ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সেই বন্দোবস্ত করতে হবে৷ অর্থাৎ প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে৷ সে জন্যই তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দেয়া প্রয়োজন৷ এই কাজগুলো সাজ সাজ রব বা হৈ চৈ করে নয়, নিরবে করতে হয়৷ পেশাদারি মনোভাব নিয়ে করতে হবে৷ গোয়েন্দা কার্যক্রমে কোনোরকম রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে না৷ এই কাজ করতে হবে একমাত্র রাষ্ট্রের স্বার্থে৷
গুলশানে এবং শোলাকিয়ায় যে ঘটনা ঘটে গেল, সেক্ষেত্রে পুলিশের কি কোনো ব্যর্থতা ছিল?
ঘটনা ঘটে গেলেই যদি ব্যর্থতা হয়, তাহলে গোটা দুনিয়াতেই তো পুলিশ বাহিনী ব্যর্থ হচ্ছে৷ কিছু ঘটনা তো ঘটবেই৷ মানুষের অসুখ হয়৷ এটা তো আর ডাক্তারের ব্যর্থতা না৷ ঘটনা ঘটবে, কিন্তু ঘটনা যাতে কম ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ প্রতিরোধমূলক ও প্রতিকারমূলক – দুই ধরনের বন্দোবস্তই নিতে হবে৷ তাছাড়া জঙ্গিদের এই তৎপরতা শুধু তো আর বাংলাদেশে হচ্ছে না৷ বিশ্বের সব জায়গাতেই ঘটনা ঘটছে৷ প্রতিবেশী ভারতে হচ্ছে, পাকিস্তানের নাম যত কম বলা যায় ততই ভালো৷ উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপের ফ্রান্সে হচ্ছে, বেলজিয়ামে হচ্ছে, অ্যামেরিকায় হচ্ছে৷ এ থেকে কারো রেহাই নেই৷ সেজন্য ঘটনা ঘটলেই ব্যর্থতা বলতে হবে, এটা ঠিক নয়৷ বরং এর থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে৷ যা বললাম, তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দিতে হবে৷ তথ্য থাকলে ভালো৷ যেমন শোলাকিয়ায় তো আমরা অনেক বড় ক্ষতি থেকে রেহাই পেয়েছি৷ একটা খবর এসেছিল যে, এখানে এমন হামলা হতে পারে৷ তাই আগে থেকেই জানতে হবে, কোথায় কোথায় এটা হতে পারে৷ এটাকে আমি ব্যর্থতা বলব না৷
পুলিশের জনবল কম থাকা কি এই ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিতে পারার কারণ?
গোয়েন্দা তথ্য বা জঙ্গিদের প্রতিরোধ করার সঙ্গে জনবলের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটা জনবলের কাজ না৷ আসলে ঠিকমতো তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন৷ আর এর জন্য কারিগরি জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করা দরকার৷ এর সাথে অধিক জনবলের কোনো সম্পর্ক নেই৷ অধিক জনবলের সম্পর্ক সেখানে আছে, যেখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় বা যে সমস্ত কাজে লোকজন বেশি লাগে৷ এটা সেরকম কোনো বিষয় নয়৷ জনবল বাড়ালেই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা আরো উন্নত, আরো ভালো হয়ে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ বরং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে পারলে তা কাজে লাগবে৷ পুলিশকে যে সম্পদ দেয়া হয়, সেটাকে যেন বিনিয়োগ মনে করা হয়৷ কারণ এর একটা ‘রিটার্ন’ আছে৷ তবে এই ‘রিটার্ন’ চোখে দেখা যায় না৷
আপনি তো বারবার বলছেন, নিয়োগ হতে হবে বিধি মোতাবেক৷ বাংলাদেশে গত ৬-৭ বছরে প্রায় ৫০ হাজার নতুন সদস্য পুলিশে যোগ দিয়েছে৷ তা এই সব নিয়োগে কোনো ধরনের ঘাটতি আপনার চোখে পড়েছে কি?
ঘাটতি কী হয়েছে, সেটা আমি বলতে পারবো না৷ তবে খালি লোক নিয়োগ করলেই তো হবে না৷ তাঁদের প্রশিক্ষণের বিষয়টাও তো দেখতে হবে...৷ সর্বশেষ ভুয়া সনদ নিয়ে ১৯-২০ জনকে ধরা হয়েছে৷ আসলে যারা মিথ্যা বলে পুলিশে ঢুকবে, তারা তো আর ভালো কাজ করবে না৷ খবরের কাগজে অভিযোগ দেখা যায় যে, চাকরি নিতে হলে নাকি পয়সা দিতে হয়৷ তা যারা পয়সা দিয়ে চাকরিতে আসবে, সে তো প্রথমেই তার পয়সাটা উঠানোর চেষ্টা করবে৷সে তো সেবা দেবে না৷ সেজন্য বিধি মোতাবেক, নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত নিয়োগ হতে হবে৷ তবে এই ৫০ হাজারের নিয়োগ সেভাবে হয়েছে কিনা, সেটা এখন যারা চাকরি করছে তারা বলতে পারবে৷
আপনি তো পুলিশ বাহিনীর প্রধান ছিলেন৷ এই বাহিনীর সদস্যদের মানসিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
‘মব়্যালিটি’ তো আর বায়বীয় পদার্থ নয়৷ মনোবল ঠিক রাখতে হলে পুলিশের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাড়াতে হবে৷ তবে যেহেতু তার কাজটা অন্যদের থেকে আলাদা, বেতন বাড়ালেই যে সে ভালো হয়ে যাবে তা নয়৷
এখানে তার প্রশিক্ষণটা ঠিক হতে হবে, তার ‘মোটিভেশন’-এর প্রক্রিয়ায় জোর দিতে হবে, যাতে নীতিজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা এই চাকরিতে থাকে৷ তাদের ‘সুপারভাইজারি’ প্রক্রিয়ায় খুব সজাগ থাকতে হবে৷ অন্যায় করলেই তাকে প্রথম চোটে ধরতে হবে, সতর্ক করতে হবে৷ একবার-দু’বার দেখতে হবে৷ কিন্তু এরপরেও না শোধরালে তাকে চাকরি থেকে বের করে দিতে হবে৷ আর চাকরির প্রথম থেকেই এগুলো দেখতে হবে, যাতে অসততা বা বেআইনি কাজ-কর্ম বেড়ে না উঠতে পারে৷ সিনিয়রদের জুনিয়রদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে৷ কিছু লোক তো খারাপ থাকবেই৷ তবে তাদের সংখ্যা যাতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি যে, পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে ‘পলিটিসাইজ’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে৷ আপনাদের সময়েও কি এ সমস্যা এতটা প্রকট ছিল?
এটা আমাদের সময় যে একেবারেই ছিল না – এমন বলা যাবে না৷ তবে এটা ব্যক্তির বিচ্যুতি৷ সংগঠন তাকে কখনোই বলে না ‘পলিটিসাইজ’ হতে৷ উল্টে সংগঠন তাকে বলে আইন মোতাবেক কাজ করতে৷ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সে৷ আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মানে তাকে আইন মোতাবেক কাজ করতে হবে৷ এই আইন মোতাবেক কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি তাকে বেআইনি কথা বলে, সেটা মানার ব্যাপারে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ এরপরেও সে যদি বেআইনি কাজে মদদ দেয়, তবে সেটা তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা, ব্যক্তিগত বিচ্যুতি৷ এটার সাথে সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এছাড়া রাজনৈতিক নির্বাহী যাঁরা, তাঁদেরও দেখতে হবে, রাষ্ট্রীয় এই অরগ্যান যেন পলিটিসাইজ না হয়৷ চূড়ান্ত বিচারে সরকারের হাত বদল হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের হাত বদল হয় না৷ সে কারণে তদন্তটা যাতে ঠিকমতো হয়, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ এক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব বিরাট৷ আর সংশোধনীমূলক এই প্রতিষ্ঠানে যারা নিয়োগ পাচ্ছে, তাদের যেন প্রভাবমুক্ত রাখা হয়৷ পুলিশে যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁদের দায়িত্ব বেশি (৭০-৮০ ভাগ)৷ বাকি ২০ ভাগ দায়িত্ব রাজনৈতিক নির্বাহীদের৷ তাই নিয়োগ যাতে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হয়, তা তাঁদেরও নিশ্চিত করতে হবে৷
সাবেক প্রধান হিসেবে বর্তমানে যাঁরা পুলিশে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
এঁরা যথেষ্ট অ্যালার্ট, ম্যাচিওর৷ এঁরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানেন৷ এঁদের বুঝতে হবে যে, তারা একটা শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করেন৷ তাই তাদের যথাযথ দায়িত্ববোধ দেখাতে হবে রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি৷ এই সমাজের প্রতিও যে তাঁর একটা ‘কমিটমেন্ট’ আছে, এই দায়িত্ব পালন করার জন্য যে তাঁদেরও একটা দায়িত্ববোধ থাকা উচিত, সেটা বুঝতে হবে৷ বলা বাহুল্য, এই দায়িত্ববোধটা প্রতিফলিত হবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার মাধ্যমে, আইন মোতাবেক কাজ করার মাধ্যমে এবং তার সাথে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার মাধ্যমে৷ এই নীতিকথাগুলো ‘ফলো’ করলেই হবে৷ এভাবে কাজ করলে নিজের কাজের প্রতি একটা সন্তুষ্টিবোধ থাকবে, তাঁরা যে সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রের হয়ে একটা গুরুদায়িত্ব পালন করছে – সেটা উপলব্ধি করবে৷ এর সঙ্গে তারা যে জনগণের সেবা করছে – এই বোধটা থাকলে নিজে থেকেই দায়িত্ব বাড়বে৷ আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর যারা অফিসার-ক্যাডার আছে, তাদের সেই দায়িত্ববোধও আছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
বিজ্ঞাপন