1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি

২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে মানুষের বিনোদনের ধরন৷ লোকজ উপাদানের গর্ভে জন্ম নেওয়া বাংলার লোকসংস্কৃতিতে এখন লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া৷ বিনোদনের নানাবিধ পসরার দৌরাত্ম্যে বাংলার চিরন্তন সংস্কৃতি কি হারিয়ে যাচ্ছে?

https://p.dw.com/p/2pudc
প্রতীকী ছবি
ছবি: DW/Payel Samanta

লোকসংস্কৃতি ব্যাপক একটা শব্দ৷ মানবজীবনের প্রতি পরতে জড়িয়ে থাকা যে বিষয়গুলি পরম্পরায় আবহমান কাল ধরে টিকে রয়েছে, তার সবকিছুই লোকসংস্কৃতির উপাদান৷ শুধু নৃত্য-গীত-বাদ্য-নাটক নয়, খাদ্যদ্রব্য থেকে বার্ষিক পার্বণ, খেলাধুলো থেকে আচার — এ সবই সংস্কৃতির বন্ধনীতে পড়ে৷ লোকসংস্কৃতির শিকড় রয়েছে গ্রামবাংলার মাটিতে৷ ‘পপুলার কালচার' বা সস্তা বিনোদন এখন শহুরে আগ্রাসন আর টিভিকে হাতিয়ার করে হানা দিয়েছে গ্রামজীবনের অন্দরে৷ এই আক্রমণ সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় লোকশিল্পীরা তাঁদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লড়াই চালাচ্ছেন, এমনটাই উঠে এসেছে ডয়চে ভেলের সরেজমিন সমীক্ষায়৷

লোকসংস্কৃতি বলতে যে উপাদানের কথা প্রথমেই মনে আসে, সেটি হচ্ছে লোকগান৷ আর লোকগানের ধারায় গোড়াতেই আসে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউলের কথা৷ কোচবিহারের বলরামপুর প্রবাদপ্রতিম ভাওয়াইয়া শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমেদের জন্মস্থান৷ তাঁর নিজভূমে ভাওয়াইয়া এখনও সদর্পে টিকে রয়েছে৷ ভাওয়াইয়া সংগীত আকাদেমি পরিষদের অধিকর্তা জয়ন্ত বর্মন বলেন, ‘‘এখনও এই জেলায় মানুষ রাত জেগে ভাওয়াইয়া শোনে৷ মানুষের সেই আগ্রহ আছে৷ অথচ অর্কেস্ট্রার গানবাজনা দু'ঘণ্টার বেশি শোনে না৷ এটাই প্রমাণ করে শহুরে সংস্কৃতি থাবা বসাতে পারেনি৷'' কিন্তু শিল্পীরা যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ অধ্যাপক বর্মনের৷ তাঁর কথায়, ‘‘আব্বাসউদ্দিন যাঁর কাছে গান শিখেছিলেন, সেই সুরেন বসুমিয়াকে আমরা ভুলে গেছি৷ তাঁরও বাড়ি ছিল বলরামপুরে৷ আব্বাসউদ্দিন ভাওয়াইয়া রেকর্ড করেছিলেন, সুরেন বসুমিয়ার সেই সুযোগ হয়নি৷'' অথচ এ সব লোকসুরেই বিখ্যাত হয়েছে কত আধুনিক গান৷ শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী নিজেদের সৃষ্টিতে তার সাক্ষ্য রেখে গেছেন, কিন্তু হারিয়ে গেছেন সুরেন বসুমিয়ার মতো কত শিল্পী৷

উত্তরবঙ্গ যদি ভাওয়াইয়ার পীঠস্থান হয়, দক্ষিণবঙ্গ বাউল সাধনার কেন্দ্র৷ বাউলের দেশ বীরভূম পর্যটকদের টানে মূলত এই গেরুয়া বসনধারী শিল্পীদের জন্য৷ এটা কি নিছকই হুজুগ, না সত্যিই আন্তরিক ভালোবাসার প্রতিফলন? অজয় নদের ধারে, কবি জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুলির ‘মনের মানুষ' আখড়ায় বসে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল তন্ময় বাউলের সঙ্গে৷ বাউলের চাহিদা বেড়েছে এটা মেনে নিয়েও তাঁর উষ্মা, ‘‘শহরের মানুষরা নিছক অবসর বিনোদন বা টাকা ওড়ানোর উদ্দ্যেশ্যেই বাউল গান বা উৎসবের আয়োজন করে৷ কিন্তু বাউলের দর্শন আত্মস্থ করার সাধনা তাদের নেই৷'' তিনি স্বীকার করেন, ব্যবসায়িক কারণে ইদানীং বাউলরাও কিছুটা প্রভাবিত হচ্ছেন৷ ভাবের পরিবর্তন ঘটছে, সুরের মিশেলও ঘটছে৷ তবে হুজুগ ছাড়াও অনেকে সত্যিই বাউল গান ও দর্শনকে আপন করে নিচ্ছেন৷

অদ্ভুত, মনোমুগ্ধকর নাচ ‘ঝুমুর’

বাংলার লোকসংস্কৃতির লুপ্ত উপাদানের তালিকায় শীর্ষে থাকবে কবিগান৷ উনিশ শতকের শুরুতে যে বাবু সম্প্রদায়ের উদ্ভব, তাদের বিনোদনের উপকরণ হিসেবে সে সময় কলকাতা-সহ গ্রামগঞ্জে জমিদারি এলাকায় কবিগান জনপ্রিয় হয়েছিল৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা, জাড়া, ক্ষীরপাই, বীরসিংহ সংলগ্ন এলাকায় তার বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ জাড়া গ্রামের লোকসংস্কৃতি গবেষক রোহিণীনাথ মঙ্গল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কলকাতার ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির মতো নামজাদা কবিয়ালরা এখানে প্রায়ই আসতেন৷ বিদ্যাসাগর মশাইও কবিগান পছন্দ করতেন৷ রাতভর চলত আসর৷ কিন্তু এখন তার চর্চা আর নেই বললেই চলে৷'' কবিগানের নিজস্ব সুর না থাকলেও কীর্তন, খেউড়, পাঁচালি, হাফ আখড়াই, আখড়াই, টপ্পা, তরজা ইত্যাদির সুর অবলম্বন করা হতো৷ বাবু বাড়িতে অগণিত দর্শকের সামনে দু'পক্ষের প্রবল লড়াই হতো, বিভিন্ন বিষয় অবলম্বন করে শিল্পীরা মুখে মুখে তৈরি করতেন গান৷ বর্ষীয়ান এই গবেষক জানান, একসময় চন্দ্রকোনার যজ্ঞেশ্বর ধোপা কলকাতার বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন৷ এখনও কিছু সংখ্যক মানুষ ভাতার প্রত্যাশায় কবিগানের সুর ব্যবহার করে গান বাধছেন বটে, তবে তাঁদের কবিয়াল বলা যায় না৷ দীর্ঘ সময় ধরে কবিগানের তরজাও আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না৷ জমিদারির অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঐতিহ্যও মুছে গেছে৷

গীত-সংগীতের মতো আধুনিক বিনোদনের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে লোকবাদ্যকে৷ একতারা, দোতারা, সারেঙ্গা, খোল, ঢোল, বাঁশি, খমক, মন্দিরা, ঝাঁজ, কাঁসর, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ ডুগডুগি — বাদ্যযন্ত্রের তালিকা অনেকটাই বড়৷ বহু লোকবাদ্যযন্ত্র বিলুপ্ত আজ৷ অধ্যাপক জয়ন্ত বর্মন বলেন, ‘‘ভাওয়াইয়া গানে ২২টি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো৷ এই যন্ত্রের শিল্পীরা রয়েছেন, কিন্তু মূলত চার-পাঁচটি যন্ত্রের অনুষঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছে ভাওয়াইয়া৷'' যে বাদ্যযন্ত্র টিকে আছে, সেগুলোকে সরিয়ে লোকগানের আসরে জায়গা করে নিয়েছে ড্রাম-গিটার-সিনথেসাইজার৷

দোলন মাহালি

সারেঙ্গী ও দোতারা প্রস্তুতকারক, জলপাইগুড়ির নরেন রায়ের বক্তব্য, ‘‘শব্দ সংযোজন করার বাড়তি আনন্দ সিনথেসাইজারে নেই, যা আছে বাংলার লোকবাদ্যে৷'' তাই আস্তে আস্তে লোকবাদ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে৷ চার দশক ধরে বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত নরেন জানান, ‘‘এখন দোতারা, সারেঙ্গী বিক্রি হচ্ছে প্রচুর৷ চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোগানো যাচ্ছে না৷ কলকাতা, শিলিগুড়ি, অসম, বাংলাদেশ-সহ নানা জায়গায় যাচ্ছে যন্ত্র৷ মূলত গানের শিক্ষক-ছাত্ররাই কিনছেন এগুলো৷''

লোকশিল্প নানা ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় সরকার তার পৃষ্ঠাপোষকতায় এগিয়ে এসেছে৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিল্পীদের নাম নথিভুক্ত করেছে, যা এক ধরনের স্বীকৃতিও বটে৷ অনেক শিল্পী সামান্য হলেও ভাতা পাচ্ছেন৷ এই অবলম্বন লোকসংস্কৃতিকে লড়ার সাহস জোগাচ্ছে বৈকি৷ এ কথা স্বীকার করলেন ঝুমুর শিল্পী দোলন মাহালি৷ বাংলার রাঢ় অঞ্চলের ঝুমুর গান ও নাচ লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান৷ একটা সময় সংকট তৈরি হলেও পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে, এ কথা জানিয়ে দোলন বলেন, ‘‘চাষবাসের সঙ্গে বাঁশ ও বেতের কাজ করেন দরিদ্র আদিবাসীরা৷ উপার্জন কমে আসায় অনেক শিল্পী ঝুমুর চর্চা ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ সরকারি ভাতা ও বিভিন্ন মেলার অনুষ্ঠান তাঁদের অনেককে আবার ঝুমুরের দিকে ফিরিয়ে এনেছে৷'' দোলনের ঝুমুর নাচের দলে ১০-১২ জন শিল্পী আছেন৷ শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির হাটে তাঁদের নাচে হাততালি পড়ছিল৷ তাতে তৃপ্ত দোলন জানান, গ্রামের অনেক অভিভাবকই এখন এই নাচ শেখায় সন্তানদের উৎসাহ দিচ্ছেন৷ সরকারের কাছে আবেদন করে ধামসা, মাদল কেনার জন্য অর্থও পাওয়া যাচ্ছে৷

অনিল মাহাতো

মঞ্চকেন্দ্রিক বিনোদনের বদলে যেদিন থেকে গণমাধ্যম মানুষের ঘরে ঠাঁই নিয়েছে, সেদিন থেকেই নয়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে লোকসংস্কৃতি৷ তবে সরকারি সহায়তায় ইদানীং শহরের বুকে লোকশিল্পীদের বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে৷ শহরের আলো ঝলমলে মঞ্চে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছৌ নাচের৷ ছৌ নাচের দল চালানোর খরচ বেশি হওয়ায় একসময় শিল্পীরা সমস্যায় পড়েছিলেন৷ ছৌ শিল্পী অনিল মাহাতো ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘পুরুলিয়ায় কম-বেশি ৩০০টির মতো ছৌ নাচের দল আছে৷ পোশাক ও মুখোশের এক একটা সেটের খরচ ২৫ হাজার টাকার মতো৷ বছরে একাধিক সেট লেগে যেত৷ একটা সময় সেই টাকা জোগাড়ে সমস্যা হতো৷ এখন সরকারি ভাতা পাচ্ছি৷ অনুষ্ঠান অনেক বেড়েছে৷ আমরা ভালো আছি৷''

ছৌয়ের মতো রায়বেঁশে নাচও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের কিছু অঞ্চলে৷ দলের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ১৭তে৷ অনুষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকায় রায়বেঁশের আরও চারটি নতুন দল হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা-সহ অন্য রাজ্যে অনুষ্ঠান করতে যায় দলগুলি৷ ইউনেস্কো এবং রুরাল ক্রাফট অ্যান্ড কালচারাল হাবের সহযোগিতায় রায়বেঁশের মতো অনেক ক্ষেত্রের লোকশিল্পীরা উপকৃত হচ্ছেন৷

লোকসংস্কৃতির ধারক হিসেবে পপুলার কালচারকে এখনো টেক্কা দিয়ে চলেছে বাংলার মেলা ও পার্বন৷ কিছুটা ধর্মের আশ্রয় ও কিছুটা উদযাপনের আনন্দ বরং উল্টে শহরের মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়েছে গ্রামের মাঠে মাঠে৷ তাই আজও কেন্দুলির জয়দেব মেলা, কোচবিহারের রাসমেলা, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা কিংবা চৈত্রে গাজনের মেলায় লাখো মানুষের ভিড় হয়৷ কীর্তন, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা টিকে আছে এভাবেই৷ কিন্তু যেখানে উদ্‌যাপন নেই, নেই ধর্মের টান, সেই লোকগাথা বা রূপকথারা আজ উপেন্দ্রকিশোর ‘টুনটুনির গল্প' বা দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি'-তে রক্ষিত৷ গ্রামবাংলায় দাদু-ঠাকুমার মুখে আওড়ানো লোকগাথার সম্ভার কি হ্যারি পটারের জাদু ছড়িতে উধাও হয়ে যায়নি? ‘কিরণমালা' কিংবা ‘সাত ভাই চম্পা' অ্যানিমেশন বা সিরিয়ালের মোড়কে ড্রয়িংরুম মাতালেও হারিয়ে গেছে একান্নবর্তী পরিবারের গল্প-বলা প্রবীণের দল৷

বর্ধমান জেলার লোককথা সংগ্রাহক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘চারিদিকে যা পরিস্থিতি, তাতে লোককথাকে বাঁচানোই মুশকিল৷ যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করলে লোককথা শেষ হয়ে যাবে৷'' আচার্য সুকুমার সেন ও আশুতোষ ভট্টাচার্যের স্নেহধন্য এই গবেষক মেনে নেন, যে শিশুরা লোককথার শ্রোতা, তাদের কাছে এখন অন্য বিনোদন এসে পড়ায় চ্যালেঞ্জ বেড়েছে৷ 

লোকসংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য অনেক সংস্থা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে৷ যেমন বাংলা নাটক ডট কম বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করছে৷ ডিসেম্বরে তাদের উদ্যোগে হচ্ছে ছৌ, ঝুমুর, পুতুলনাচের আয়োজন৷ পুরুলিয়ার চড়িদায় রয়েছে ছৌ মুখোশের কর্মশালা৷ সংগঠনের ম্যানেজার নির্মাল্য রায় ডয়চে ভেলেকে আশাবাদের কথা শোনান৷ বলেন, ‘‘লোকসংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে নেমে দেখতে পাচ্ছি লোকশিল্পীদের উদ্যম নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে৷ পাশাপাশি লোকসংস্কৃতি শিল্পী-সহ গ্রামকে গর্বিত করছে৷ সামাজিক উন্নয়নও হচ্ছে৷ এটা খুবই ইতিবাচক৷''

পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি নিয়ে প্রতিবেদনটি আপনাদের কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য