গ্রীষ্ম গেল বর্ষা এল, জার্মানিতে খুব বেড়ালো পর্যটকের ঢল
১৮ আগস্ট ২০১০ভিক্টোরিয়া নাম তার৷ বসবাস নিউ ইয়র্কে৷ এক বছর ধরে পয়সা জমিয়ে ছেলেবন্ধুকে বগলদাবা করে এই গ্রীষ্মটা কাটাতে এসেছিলেন জার্মানিতে৷ বার্লিনে বিয়ারপান, হামবুর্গ বন্দরের সাদা সমুদ্রে স্নান, কৃষ্ণ অরণ্য বা ব্ল্যাক ফরেস্টে হাইকিং বা হাঁটাহাঁটি আর পুবের শহর থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় কুক কুক করে সময় জানান দেওয়া কুকুক ঘড়ি কিনে এই তো গত রোববার ভিক্টোরিয়া যুগলে উড়ে চলে গেল আটলান্টিকের ওপারে৷ অ্যামেরিকায়৷
অ্যামেরিকা থেকে তো বটেই, সুদূর অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মেক্সিকো কিংবা এশিয়ার ভারত কিংবা ইন্দোনেশিয়া থেকেও বহু পর্যটক এই গ্রীষ্মে জার্মানিতে উড়ে এসে ঘুরেঘারে গেলেন৷ সকলেরই এক কথা, ‘জিনিসপত্রের দাম একটু বেশি বটে, তবে চমত্কার বেড়িয়েছি৷ কারণ, দেশটা এতটাই সুন্দর, এতটাই সাজানোগোছানো আর এতই ভালো ব্যবস্থা এদেশে যে বেড়ানোর জন্য আদর্শ৷'
আদর্শ হবে না? পর্যটনে উত্সাহ দিতে জার্মান সরকার বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে যে গত এক বছর ধরে৷ সেই ২০০৬ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে স্বাভাবিকভাবেই জার্মানিতে গোটা দুনিয়া থেকে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল৷ রমরম করে চলেছিল হোটেল সহ যানবাহন, পর্যটনকেন্দ্র সবকিছুর ব্যবসাপত্র৷ কিন্তু, তারপর থেকে আবার যে কে সেই৷ জার্মানদের যদিও যথেষ্ট সুনাম আছে পর্যটক হিসেবে৷ অর্থাৎ, জার্মানদের মত এত ভ্রমণপ্রিয় জাত দুনিয়ায় বেশি নেই৷ কিন্তু, সেই জার্মানিতে বেড়াতে আসার ব্যাপারটা ততটা জনপ্রিয় কি?
প্রশ্নটা ভুল নয় খুব৷ অন্তত এতদিন তো তেমনই শোনা যেত৷ কিন্তু প্রায় শেষ হতে চলা এবারের গ্রীষ্মে বেশ ভালোই ভিড়ভাট্টা হয়েছিল জার্মানিতে৷ জার্মানি বিষয়ে ইউরোপে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে কয়েকটি জিনিসের কিন্তু দুরন্ত প্রসিদ্ধি৷ যেমন এক নম্বর হল জার্মানির ঘন্টায় ঘন্টায় কুকুক বা মোরগডাক ঘড়ি৷ কৃষ্ণঅরণ্য, বা ব্ল্যাকফরেস্ট কিংবা জার্মান ভাষায় শোয়ারৎসভাল্ডের শহরগুলোতে যে ঘড়ি কিনতে লাইন পড়ে যায় পর্যটকদের৷ স্টুটগার্ট থেকে ট্রিব্যার্গ পর্যন্ত কুকুক ঘড়ির খ্যাতি৷
দুনম্বর প্রসিদ্ধি হল জার্মানির অসামান্য স্বর্গসমান নিসর্গ৷ তার কৃষ্ণপাহাড়, তার নিবিড় অরণ্য, তার সীমাহীন ক্যালেন্ডারছবি ল্যান্ডস্কেপ, তার বিশাল জলপ্রপাতের ধ্বনি, তার রাইন নদীর দেশজোড়া বিস্তার, পাকদন্ডী পথে তার অসামান্য ওঠাপড়া৷ রাইনের দক্ষিণতীরে একের পর এক ভিনিয়ার্ড, আঙুরের চাষ৷ লালসাদা আঙুরের ফলন, পাশে পাশেই ওয়াইন তৈরির ঘরোয়া থেকে বিশাল কারখানা৷ আর নদীর উত্তর তীরে পাহাড়ি রেলগাড়ি নদীর সঙ্গে বাঁক নিয়ে নিয়ে চলে৷ রেলগাড়ির নাম আইসিই৷ ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস৷ তার গতিবেগ ঘন্টায় তিনশো কিলোমিটার৷ রুপোলি তার রঙ৷ যেন মাটির ওপর দিয়ে দ্রুতবেগে চলা এক চলন্ত বিমান৷
আরও আছে৷ আছে জার্মান সওনার অন্যান্য শীতের দেশে একটু লজ্জা লজ্জা খ্যাতি৷ সেটা এরকম৷ জার্মানিই হল এই দুনিয়ার একমাত্র দেশ, যেখানে সওনাতে যেতে গেলে শরীরে কোনরকম পোষাক পরা চলে না৷ কারণ, স্বাস্থ্যবিধিতে বলা হয়, শীতের দেশে সওনা বা বাস্পস্নানের সময়ে শরীরে কোন পোষাক থাকলে তার থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া ছড়াতে পারে সাধারণের স্নানঘরে বা সওনায়৷ সেই ব্যাকটিরিয়াতে আক্রান্ত হতে পারেন অন্যরা৷ ফলে আপনার রোগভোগ ছড়িয়ে যেতেই পারে অন্যের দেহে৷ তো, সেই বিধি অনুযায়ী জার্মান সওনায় পরিষ্কার তোয়ালেতে শরীর মুড়ে যাওয়াই নিয়ম৷ পোষাক বা অন্তর্বাস! নৈব নৈব চ৷ আর এই সবখোলা স্বাধীন সওনার স্বাদ নিতে অনেকেই আসেন জার্মানিতে৷ বিশেষত শীতকালে৷ যখন সওনাটা বড়ই আরামের ব্যাপার৷ ‘কিন্তু এই গ্রীষ্মেও আমরা বেশকিছু তেমন খদ্দের পেয়েছি৷ যাঁরা হোটেলে ঢুকেই প্রথমে জানতে চেয়েছেন, সওনা চালু আছে তো আপনাদের হোটেলে?' বলছিলেন রাজধানীতে হোটেল বার্লিনের ম্যানেজার টোবিয়াস শিফার৷
সব মিলিয়ে এই গ্রীষ্মটা পর্যটকের আনাগোনায় ভালোই কেটে গেল জার্মানিতে৷ খানিকটা চাঙ্গা হল পর্যটনশিল্প৷ মন্দা কাটাতে এটাও একটা প্রয়োজনীয় দিক বৈকি!
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন