গোপন অনলাইন জীবন ফাঁস
১৫ জুলাই ২০১৩আপনি যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তখন বিভিন্ন রকম তথ্য তৈরি করেন যা সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা সম্ভব৷ এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে৷ ধরুন, একদিন আপনি গুগলে সস্তা ফার্নিচার খুঁজলেন৷ এরপর দেখতে পেলেন, আপনি যে ওয়েবসাইটেই প্রবেশ করেন না কেন, সেই ওয়েবসাইটের স্বয়ংক্রিয় বিজ্ঞাপনের ঘরে প্রদর্শন হচ্ছে সস্তা ফার্নিচারের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন৷ অর্থাৎ আপনার খোঁজের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপনগুলো সাজিয়ে পরিবেশন করছে বিভিন্ন ওয়েবসাইট৷
বিভিন্ন ওয়েবসাইট আপনার পছন্দের বিষয়গুলি জানার জন্য ‘কুকিস' অনুসরণ করে৷ এসব কুকিস ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ওয়েব ব্রাউজারেই জমা থাকে৷ এদের কাজ হচ্ছে আপনার পছন্দের বিষয় সম্পর্কে খোঁজ রাখা এবং প্রয়োজনমত সেগুলো অন্য সেবাদাতাকে জানানো৷ আর আপনার ইন্টারনেট জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ৷ কেননা, এভাবে তারা সহজে আপনার আরো কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়৷
গোয়েন্দারা কুকিসের ব্যাপারে আগ্রহী নয়
তবে গুপ্তচর বিভাগ কুকিসের ব্যাপারে আগ্রহী নয়৷ তারা অনেক বেশি আগ্রহী ‘মেটাডাটা' সম্পর্কে৷ নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবভিত্তিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে পাওয়া যায় মেটাডাটা বা সহজ করে বললে আপনার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ডিজিটাল ছবির কথা৷ এসব ছবির সঙ্গে মেটাডাটা হিসেবে থাকে কোন ক্যামেরায় ছবিটি তোলা, ছবির রেজ্যুলেশন এবং অ্যাপারচারসহ বিভিন্ন তথ্য৷ কিছু ক্যামেরায় তোলা ছবিতে আবার কোথায় সেটি তোলা হয়েছে সেই তথ্যও পাওয়া যায়, যদি ব্যবহারকারী ট্রাকিং ফাংশন বন্ধ করে না দেন৷
এভাবে কে কাকে ই-মেল করছে এবং কখন? সেই তথ্যও থাকে মেটাডাটায় যা গুপ্তচর বিভাগে পেতে চায়৷ একেবারে প্রেরক, ঠিকানা, তারিখ থেকে শুরু করে যে সার্ভার ব্যবহার করে ই-মেলটি করা হয়েছে, সেই তথ্যও এভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব৷
ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)-এর বিশেষজ্ঞরা ব্যবহারকারীকে এই বিষয়ে ধারণা দিতে একটি পাতা খুলেছে৷ ‘‘এনএসএ ইওরসেল্ফ'' শীর্ষক এই পাতায় প্রবেশ করে একজন ব্যবহারকারী জানতে পারেন, তাঁর সম্পর্কে কতটা তথ্য মেটাডাটার মাধ্যমে অন্যের পক্ষে জানা সম্ভব৷ বর্তমানে জিমেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীরা এমআইটি-র বিশেষজ্ঞদের তৈরি এই ব্যবস্থা পরীক্ষা করতে পারেন৷ এভাবে অনেক তথ্যই জানা সম্ভব৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির সাবেক কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন ইতোমধ্যে গোটা বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছেন৷ তিনি ইন্টারনেটে সাধারণ মানুষের উপর মার্কিন গোয়েন্দাদের মাত্রাতিরিক্ত নজরদারি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করেছেন৷ এমনকি যাঁরা মনে করেন ইন্টারনেটে তাঁদের লুকানোর কিছু নেই, তাঁরাও এখন বিশ্বাস করছেন যে গোয়েন্দাদের কর্মকাণ্ড সম্ভবত শুধুমাত্র সন্দেহভাজনের ই-মেল পড়া বা ফোনে আড়িপাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷
মেটাডাটা থেকে তথ্য সংগ্রহ সম্পর্কে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ইয়র্গ ব্রুন্সমান বলেন, ‘‘প্রথমে শুধু তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷ এরপর একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু দিক নির্ধারণ করে সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়৷ সবকিছুই করা হয় মেশিনের মাধ্যমে৷''
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ওসামা বিন লাদেনের কথা৷ দেখা গেল মেশিন বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার করেছে, জন স্মিথ নামক কাউকে ৩০ বার ই-মেল করেছে ওসামা বিন লাদেন৷ বিন লাদেন এখন মৃত, কিন্তু জন স্মিথ জীবিত৷ ফলে বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক৷ কিন্তু পরে যদি ই-মেলের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা পোষা বিড়াল নিয়ে আলাপ করেছেন, তাহলে সেটা কোনো কাজের নয়৷
এনক্রিপশন কি সমাধান?
বর্তমানে খুব কম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ই-মেল এনক্রিপ্ট করছে৷ তবে যেকেউ চাইলে এটা করতে পারে৷ কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিক বুর্কহার্ড স্র্যোডার এই বিষয়ে বলেন, ‘‘ইন্টারনেটে সহজেই ট্রুক্রিপ্ট বা জেনুপ্রাইভেসিগার্ড-এর মতো প্রোগ্রাম পাওয়া যায়৷'' তবে সমস্যা হচ্ছে এনক্রিপ্ট তখনই কাজ করবে যখন, প্রেরক এবং প্রাপক উভয়ই একই প্রোগ্রাম ব্যবহার করবে৷ আর মেটাডাটা এনক্রিপ্ট হয় না৷
ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য সম্ভাব্য সমাধান হচ্ছে ডার্কনেট ব্যবহার করা যেখানে টিওআর-এর মতো নেটওয়ার্কগুলো অনেক সার্ভারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে এবং এসব নেটওয়ার্ক ক্রমাগত ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট ঠিকানা বদলাতে থাকে৷ সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে৷
ইন্টারনেটে পদাঙ্ক রেখে যাওয়া
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা প্রতিদিনই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কিছু না কিছু তথ্য যোগ করেন৷ বিশেষ করে ফেসবুক এবং টুইটারে একজন ব্যবহারকারী শুধু নিজের সম্পর্কে সাধারণ তথ্যই জানাচ্ছেন না, তাঁরা তাঁদের পছন্দ, অপছন্দ এমনকি বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও বিভিন্নভাবে জানাচ্ছেন৷ আর এসব নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন তথ্য তৃতীয় সেবাদাতাদের ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে৷ একইভাবে বিভিন্ন স্মার্টফোন অ্যাপসও ব্যবহারকারীদের ধারণার চেয়ে বেশি তথ্য তাঁদের কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে৷
ফলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, ইন্টারনেটে কোনো কিছু শেয়ার করার আগে বেশি করা ভাবা উচিত৷ অপ্রয়োজনে কোনো তথ্য শেয়ার না করাই ভালো৷ তবে বর্তমানে তথ্য শেয়ারের চেয়েও বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি করছে মেটাডাটা৷ কেননা, বাস্তবতা হচ্ছে এসব গোপন ডাটাও ঘাটাঘাটি সম্ভব৷