‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ এবং সিনেমার স্টেরিওটাইপ
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন যত তীব্র হয়ে উঠছে, বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বর্ণবাদ নিয়েও আলোচনা বাড়ছে৷ ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ সিনেমাটি একটি অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে নেয়া হয়েছে৷ অন্য অনেক চলচ্চিত্র নিয়েও উঠছে প্রশ্ন৷
‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ ও বিতর্ক
বিশ্বব্যাপী ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের পর প্রশ্ন উঠেছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসও কি নতুন করে লেখা হবে? এমন প্রশ্নের মুখে স্ট্রিমিং প্লাটফরম এইচবিও ম্যাক্স থেকে জনপ্রিয় ক্লাসিক ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ সাময়িকভাবে সরিয়ে নেয় ওয়ার্নারমিডিয়া৷ প্রতিষ্ঠানটি স্বীকার করেছে সিনেমাটিতে যেভাবে দাসদের জীবনকে ‘মহান’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, বাস্তব চিত্র আসলে তা ছিল না৷
যুক্ত হবে সমালোচনাও
এইচবিও ম্যাক্স অবশ্য দ্রুতই সিনেমাটি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে৷ তবে এবার এর শুরুতে একটি লেখা জুড়ে দেয়া হবে, যাতে সিনেমা ও তৎকালীন সমাজের ইতিহাসের কথাও বলা থাকবে৷ কিন্তু তারপরও এ নিয়ে আলোচনা চলছেই৷ কারণ এমন আরো অনেক চলচ্চিত্র দাসপ্রথাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
‘দ্য বার্থ অব আ নেশন’
নির্বাক যুগের মার্কিন চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর একটি ডি ডাব্লিউ গ্রিফিথের ‘দ্য বার্থ অব আ নেশন’৷ ১৯১৫ সালের এই তিন ঘণ্টার সিনেমাতে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের চিত্র দেখানো হয়৷ আফ্রো-অ্যামেরিকানদের জীবনকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই সিনেমায়৷ সিনেমায় হয় তাদেরকে খারাপভাবে দেখানো হয়েছে, অথবা স্বেচ্ছায় শ্বেতাঙ্গ অ্যামেরিকানদের সহযোগিতা করতে দেখানো হয়েছে৷
‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’
১৯২৭ সালের ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাতগুলোর একটি৷ সিঙ্ক্রোনাইজড সাউন্ডট্র্যাকে রেকর্ড করা প্রথম ফিচার ফিল্ম এটি৷ প্রধান চরিত্র আল জ্যাকসন এই সিনেমায় ব্ল্যাকফেইস হিসেবে অভিনয় করেন৷ তখনকার সময়ে ব্ল্যাকফেইস বা কৃষ্ণাঙ্গদের মতো করে সাজা খুব স্বাভাবিকভাবে দেখা হতো৷ কিন্তু এখন এমন আচরণকে বর্ণবাদী বলে ধরে নেয়া হয়৷
রেড ফেইসিং
ব্ল্যাকফেইস এর মতো আরেকটি বর্ণবাদী আচরণ ছিল রেডফেইস৷ বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতারা আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের চরিত্রে অভিনয় করতেন পালক, ছেঁড়া কাপড় ও গায়ে-মুখে লাল রঙ মেখে৷ ১৯৫৪ সালের ‘টাজা, সন অফ কোচিস’ এমন একটি সিনেমা৷
‘দ্য সার্চার্স’
সিনেমার ইতিহাসে খ্যাতি ও নৈতিকতার দ্বন্দ্বের আরেকটি বড় উদাহরণ ‘দ্য সার্চার্স’৷ ১৯৫৬ সালের এ সিনেমাকে মাস্টারপিস হিসেবে মনে করা হয়৷ বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও বেশ প্রভাব রেখেছে এই চলচ্চিত্র৷ কিন্তু এই সিনেমাতেও তুলে ধরা হয়েছে বর্ণবিদ্বেষ৷
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সিনেমা
অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়া বিভিন্ন চলচ্চিত্রে যে কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধেই বর্ণবাদ প্রদর্শন করা হয়েছে, তা না৷ ১৯৭৮ সালের ‘দ্য ডিয়ার হান্টার’ সিনেমাটিতে একপাক্ষিকভাবে উত্তর ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের সবাইকে বর্ণবাদী ও খুনি হিসেবে দেখানো হয়৷
‘অ্যাপোক্যালিপস নাও’
ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপ্পোলার ১৯৭৯ সালে নির্মিত এই সিনেমাটিকেও শিল্পগুণের বিচারে মাস্টারপিস হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ কিন্তু এখানেও কেবল শেতাঙ্গ চরিত্রগুলোকেই মহিমান্বিত করে দেখানো হয়েছে৷ অন্যদিকে ভিয়েতনামের সব চরিত্রকে দেখানো হয় নামহীন স্টেরিওটাইপ চরিত্র হিসেবে৷
‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ’
১৯৬০ এর দশকে বর্ণবাদী হাস্যরস বেশ স্বাভাবিক ঘটনা ছিল৷ এশিয়ার বিভিন্ন চরিত্রকে হাস্যরসাত্মক উপায়েই উপস্থাপন করা হতো৷ ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ’ চলচ্চিত্রে এমনভাবেই তুলে ধরা হয় মিস্টার ইউনিওশি নামের জাপানি এক চরিত্রকে৷ এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে সমালোচনা৷
হলিউডে ল্যাটিনো: ‘মেইড ইন ম্যানহাটন’
যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশই ল্যাটিনো৷ ডয়চে ভেলের এক সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা গেছে দেশটির সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীও ল্যাটিনোরাই৷ ২০০২ সালের ‘মেইড ইন ম্যানহাটন’ এর মতো সিনেমায় তাদেরকেও দেখানো হয়েছে স্টেরিওটাইপ চরিত্রে৷ জেনিফার লোপেজের চরিত্র এক রাজনীতিবিদের প্রেমে পড়ে যায়৷ প্রায়শই ল্যাটিনো নারীদের দেখানো হয় এমন যৌন আবেদনময়ী চরিত্রে৷
হলিউডে জার্মান
অনেক জার্মান ও অস্ট্রিয়ান অভিনেতা নাৎসি আমলে পালিয়ে হলিউডে আশ্রয় নেন৷ তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন সিনেমায় মূলত নাৎসি চরিত্রগুলোতে অভিনয় করানো হতো৷ যেমন ১৯৪২ সালের ‘কাসাব্লাঙ্কা’ সিনেমায় মেজর স্ট্রাসার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কনরাড ভাইড্ট৷ এমনকি যুদ্ধ শেষ হওয়ার দীর্ঘদিন পরেও জার্মানভাষী অভিনেতাদের দিয়ে এসব অভিনয় করানো হতো৷
‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডর্স’
এখনও স্টেরিওটাইপে পরিপূর্ণ এসব সিনেমা তৈরি হতে দেখা যায়৷ এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ২০০৯ সালের ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডর্স’৷ কোয়েন্টিন টারানটিনোর এ সিনেমায় জার্মান-অস্ট্রিয়ান অভিনেতা ক্রিস্টোফ ওয়াল্টৎস এক নাৎসি চরিত্রে অভিনয় করেন৷ এ চরিত্রে তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করলেও প্রশ্ন উঠেছে আর কতো দিন জার্মান বংশোদ্ভূত অভিনেতাদের দিয়ে এমন নাৎসি চরিত্রে অভিনয় করানো হবে?
নাৎসি প্রোপাগান্ডা ও ‘ইয়ুড স্যুস’
নাৎসি নেতারাও কিছু সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানো৷ এমন অনেক চলচ্চিত্র এখন বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে৷ যেমন ১৯৪০ সালের ‘ইয়ুড স্যুস’ সিনেমা এখন কেবল গবেষণার জন্য দেখার অনুমতি দেয়া হয়৷