গণতন্ত্র কি হুমকির মুখে?
১৮ এপ্রিল ২০১৩এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক উদীয়মান দেশে এলিট শ্রেণির কাছে গণতন্ত্র উন্নয়ন ও প্রাচুর্যের প্রতীক হতে পারে, কিন্তু ইউরোপের কিছু দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে চলেছে৷
জার্মানির বৈদেশিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গ্যোটে ইনস্টিটিউট ও নেমেচেক ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ‘ম্যাপিং ডেমোক্র্যাসি' নামের একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল৷ ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক উটে শেফার সহ বেশ কয়েকজন বক্তা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাঙ্গেরি ও রাশিয়ার বক্তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন৷
পরিস্থিতি আলাদা, তবে ক্ষোভ কম নয়
জার্মানি, হাঙ্গেরি ও রাশিয়া – এই তিন দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ আলাদা আলাদা পর্যায়ে রয়েছে৷ তবে তিনটি দেশেই গণতন্ত্রের বিপদ ও তার মোকাবিলার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চলছে৷ রাশিয়ায় রাষ্ট্রের থাবা ও ক্ষমতাসীন দলের পেশিশক্তি প্রদর্শনের ফলে সুশীল সমাজ সংকটে পড়েছে৷ হাঙ্গেরির বিরোধী পক্ষ একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকার হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে৷ সে দেশের দক্ষিণপন্থি সরকার সংবিধানে পরিবর্তন এনে ইতিমধ্যেই অনেক অধিকার খর্ব করেছে৷ জার্মানিতে পরিস্থিতি এতটা নাটকীয় না হলেও সাধারণ মানুষ সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আর আগের মতো আস্থা রাখতে পারছেন না৷ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বর্তমান সংকটগুলি সামলাতে পারছেন কি না, তা নিয়ে তাঁদের মনে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে৷
নাগরিকদের ভূমিকা
তবে সব দোষ রাজনীতিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলে না৷ গণতন্ত্রে নাগরিকদের ভূমিকাও কম নয়৷ যেমন জার্মানি লেখিকা ডানিয়েলা ডান মনে করেন, নাগরিকরা ‘প্রত্যক্ষদর্শী' হিসেবে গণতন্ত্রকে দেখছেন৷ তিনি নিজে সাবেক পূর্ব জার্মানির বিপ্লবের সময় নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ তাঁর মতে, নির্বাচিত রাজনীতিকদের প্রতি আজকের নাগরিকদের বেশি ধৈর্য দেখানোর প্রয়োজন নেই৷ তাছাড়া ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ফারাক বেড়েই চলেছে৷ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আজকাল আর ভোটারদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছেন না৷ নিজের স্বার্থ, দলের স্বার্থ বা যারা অর্থ বা চাঁদা দিচ্ছে, তাদের স্বার্থ রক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকেন তাঁরা৷ অর্থাৎ জার্মানির সংবিধান নাগরিকদের হাতে যে ক্ষমতা দেবার কথা বলে, বাস্তবে তার প্রতিফলন সবসময়ে দেখা যায় না৷
আজকের খোলামেলা পরিবেশ
তবে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পাউল নল্টে মনে করেন, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের পর থেকে আজ পর্যন্ত জার্মানির সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে৷ যে তরুণ-তরুণীরা আজকের খোলামেলা পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন, তারা কল্পনাই করতে পারবেন না, কয়েক দশক আগেও পরিবেশ কতটা আড়ষ্ট ছিল৷ পুরুষতান্ত্রিক সেই কাঠামোয় নারীদের প্রায় কোনো গুরুত্বই ছিল না৷ তাঁর মতে, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বাড়ার থেকেও আরও বড় সমস্যা হলো ভোটার হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্তদের বেড়ে চলা গুরুত্ব৷ রাজনীতিকরা তাঁদের কথা ভেবেই কাজ করেন৷ ফলে নিম্নবিত্তদের স্বার্থরক্ষা করতে কেউ প্রস্তুত নয়৷ তাদের কোনো লবি নেই৷
পূর্ব ইউরোপের বিকাশ
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু কাগজে-কলমে গণতন্ত্র এলেও অনেক দেশে নাগরিকদের কণ্ঠ যথেষ্ট জোরালো হয়ে উঠতে পারে নি৷ তারা নতুন ব্যবস্থায় টিকে থাকতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ হাঙ্গেরির মতো দেশ ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে৷ কিন্তু ইউরোপীয় মূল্যবোধ সে দেশে পুরোপুরি পৌঁছায় নি৷ ফলে ভিক্টর ওরবানের মতো দক্ষিণপন্থি নেতা সংবিধানে পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করলেও সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে৷
রাশিয়ার সুশীল সমাজ রাষ্ট্রের চরম পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে৷ ‘পুসি রায়ট'-এর মতো রক-ব্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসন সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে৷ তবে গোটা বিশ্ব তাদের পরিণতি নিয়ে আগ্রহী হলেও রাশিয়ার বেশীরভাগ মানুষ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না বলে মনে করেন সাংবাদিক ও রাজনীতিক মিখাইল গেলফান্ড৷ তাঁর মতে, যে কোনো গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা৷ রাশিয়ায় তা ঘটছে না বলে তিনি মনে করেন৷