খেলাধুলায় ‘মেগা-ইভেন্ট’-এর দিন কি শেষ হতে চলেছে?
২৯ জুন ২০১৩মেগা-ইভেন্ট বা সুবিশাল আয়োজন কথাটাতেই সমস্যার মূল লুকিয়ে রয়েছে৷ খেলাধুলার বড় বড় অনুষ্ঠান বা উৎসবগুলি এতই ‘মেগা' হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অধিকাংশ দেশের পক্ষেই সে বোঝা বওয়া দৃশ্যত সম্ভব নয়৷ সুবৃহৎ, চকচকে স্টেডিয়াম গড়তেই এত অর্থ ব্যয় হচ্ছে যে, মেগা-ইভেন্ট থেকে অবকাঠামো সংক্রান্ত যে উন্নয়ন ঘটার কথা ছিল, তার সামান্যই ঘটছে৷
ব্রাজিলের কথাই ধরা যাক৷ কনফেডারেশন্স কাপ চলাকালীনই ব্রাজিল প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে৷ ২০১৪ সালে আছে ফুটবল বিশ্বকাপ৷ তার ওপর আবার ২০১৬ সালে রিও ডি জেনিরোতে অলিম্পিক্স৷ ইতিমধ্যে নতুন নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু স্বাস্থ্য? শিক্ষা? পরিবহণ? এছাড়া স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে সরকারি অর্থেই, যদিও ২০০৭ সালে ব্রাজিলের তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী অর্লান্ডো সিলভা বলেছিলেন, বিশ্বকাপের সব স্টেডিয়াম তৈরি হবে বেসরকারি বিনিয়োগে৷ স্টেডিয়ামগুলি ঠিকঠাক করার জন্য নাকি এক পাই সরকারি অর্থ ব্যয় করা হবে না৷
আজ ব্রাজিলের বাস্তবিক পরিস্থিতি এই যে, বিশ্বকাপের খেলা হবে এমন অন্তত পাঁচটি শহরে প্রতিশ্রুত বাস, মেট্রো কিংবা ট্রামলাইন চালু হবে না৷ কিছু শহর তো খেলার দিনগুলোকে ছুটির দিন বলে ঘোষণা করার কথা ভাবছে, যা-তে যানজট না হয়৷ সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের ‘লেগাসি' বা উত্তরাধিকার হবে একাধিক বড় বড় স্টেডিয়াম, যেগুলোর পরে বিশেষ কোনো উপযোগিতা না-ও থাকতে পারে৷ সেভাবেই ব্রাজিলের মানুষদের ঊষ্মাটা বুঝতে হবে৷
স্থায়ী উত্তরাধিকার
সাইমন চ্যাডউইক ইংল্যান্ডের কোভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস মার্কেটিং-এর অধ্যাপক৷ তিনি রয়টার্সের প্রতিবেদককে বলেছেন, ফিফা-র উচিত, বিশ্বকাপ যা-তে দু'সপ্তাহের একটা লোক-দেখানো আয়োজন না হয়ে, স্থায়ী একটা উত্তরাধিকার হয়, ফিফা-র সেটা নিশ্চিত করা উচিত৷ অবশ্য ফিফা-র তরফ থেকে কোনোদিনই এই ‘লেগাসি'-র ব্যাপারটাকে বড় করে তুলে ধরা হয়নি৷ ফিফা – সঙ্গত কারণেই – ফুটবলের বিকাশেই বেশি আগ্রহী৷
তা সত্ত্বেও ফিফা-কে ব্রাজিলের দাঙ্গা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে, কেননা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মেগা-ইভেন্ট আয়োজন করার ব্যাপারে দ্বিধা পোষণ করতে শুরু করেছে৷ তার নানা লক্ষণও দেখা দিয়েছে৷ খোদ সুইজারল্যান্ডে মানুষজন গণভোট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক্স অনুষ্ঠানের জন্য সুইজারল্যান্ড প্রার্থী হবে না৷ ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্স অনুষ্ঠানের জন্য পাঁচটি মাত্র আবেদন জমা পড়েছে: ইস্তানবুল, মাদ্রিদ, টোকিও, বাকু এবং দোহা৷
নিয়ন্ত্রণের বাইরে?
বলতে কি, এই সব মেগা-ইভেন্ট আয়োজনের জন্য প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করতেই লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ হয়৷ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একদিন এই দাঁড়াতে পারে যে, বিশেষ কয়েকটি দেশ বারংবার ইভেন্টগুলির আয়োজন করবে, যা খেলাধুলা কিংবা গণতন্ত্র, কোনোটার পক্ষেই মঙ্গলজনক নয়৷ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে এ ধারণা আরো বেড়েছে যে, এই মেগা-ইভেন্টগুলি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে৷
গতমাসে বার্লিনে বিশ্বের ক্রীড়ামন্ত্রীদের একটি সম্মেলন হয়, যার উদ্যোক্তা ছিল ইউনেস্কো৷ সম্মেলনের ঘোষণায় খোলাখুলি বলা হয়, বহু ঢাউস স্টেডিয়াম ইভেন্টের পর নিজের খরচ চালাতে পারে না, ওদিকে বিনিয়োগকারী পাওয়াও শক্ত৷ আমন্ত্রণকর্তা দেশগুলির কাছ থেকে ক্রমেই আরো বেশি দাবি করলে কিছু দেশ অনুষ্ঠান আয়োজনের আবেদন করাই বন্ধ করে দিতে পারে, এই হলো ক্রীড়ামন্ত্রীদের আশঙ্কা৷
পালাবদলের খেলা
অশনি সংকেত উয়েফা-রও নজরে পড়েছে৷ ২০২০ সালের ইউরাপীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের জন্য মাত্র তিনটি আবেদন পড়লে, উয়েফা সারা মহাদেশের ১৩টি শহরে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়৷ প্রত্যেকটি দেশে তিন থেকে চারটি খেলা অনুষ্ঠিত হবে৷ কোনো দেশের হাজার ত্রিশেক দর্শক ধরার মতো একটিমাত্র স্টেডিয়াম থাকলেই চলবে৷
ফিফা-র কথাটা আলাদা৷ ফিফা ইতিমধ্যেই ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ রাশিয়াকে এবং ২০২২ সালের বিশ্বকাপ তেল-সমৃদ্ধ কাতারকে দিয়ে বসে আছে৷ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠান করতে গেলে ফিফা-র জন্য কর ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হয়৷ এবার তো ব্রাজিলকে স্টেডিয়ামের ভিতরে সুরাজাতীয় পানীয় বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে তুলে নিতে হয়েছে৷ ফিফা হয়ত সময়ে খেয়াল করতে পারেনি, ফুটবল বদলায়নি, শুধু দুনিয়াটাও বদলে গেছে৷
এসি/ডিজি (রয়টার্স)