এক সাথে বসবাস
২৮ জুলাই ২০১৩টিনা আর্নট কোনো বৃদ্ধাশ্রমে বাস করেন না৷ থাকেন না কোনো ভাড়া বাড়িতেও৷ আর্নট বাস করেন বন শহরের একটি বিশেষ ধরনের আবাসিক প্রকল্প ‘আমারিলিস'-এর একটি বাড়িতে৷ এই প্রকল্পের বাড়িগুলি যৌথ পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়৷ পার্থক্য হলো, এখানে প্রত্যেক ভাড়াটের আলাদা আলাদা বাসা আছে৷ তিন প্রজন্মের মানুষ একই কমপ্লেক্সে বসবাস করেন৷ একে অপরকে সহায়তা করেন৷ এমনকি গাড়িও ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন তাঁরা৷
‘‘আমি মানুষের মধ্য থাকতে ভালোবাসি৷ আরো কম বয়সেই আমি এ ধরনের প্রকল্পের কথা চিন্তা করেছিলাম, গড়ে তোলার উদ্যোগও নিয়েছিলাম৷ কিন্তু সফল হইনি৷ তারপর ইন্টারনেটে দেখা শুরু করলাম৷ ‘বৃদ্ধদের জন্য বসবাসের সুযোগ-সুবিধা' – এই বিষয়টি উল্লেখ করতেই আমারিলিস-এর নামটি বের হয়ে এল'', বলেন টিনা আর্নট৷
গ্যার্ড হ্যোনশাইড গ্রস এই প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের একজন৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই বাড়িটি নিজেরাই বানিয়েছি৷ আমরা নিজেরাই মালিক৷ কোনো ম্যানেজার বা বিনিয়োগকারী নেই আমাদের৷ সব কিছু আমরা নিজেরাই দেখাশোনা করেছি৷''
রয়েছে বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ
শুধু বাড়িটি নির্মাণই নয়, দৈনন্দিন কাজও একসাথে মিলে সম্পন্ন করেন বাসিন্দারা৷ এ জন্য রয়েছে বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ৷ বয়স্করাও এই সব গ্রুপে সক্রিয়৷ মিডিয়ার আগ্রহ দেখে এমন একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গড়ে তোলা হয়েছে, যেটা শুধু মিডিয়ার প্রশ্নোত্তর নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে৷ গ্যার্ড হ্যোনশাইড গ্রস ও তাঁর স্ত্রীও যুক্ত এই গ্রুপে৷
আমারিলিস আবাসিক কমপ্লেক্সে ৫০ জন বয়স্ক আর ২০ জন তরুণ ছেলে-মেয়ে বসবাস করেন৷ বয়স্করা বাচ্চাদের সাহায্য করেন, বাচ্চারা করে বয়স্কদের সাহায্য৷ ‘‘এটা আমার কাছে চমত্কার মনে হয়৷ আনন্দও লাগে৷ মানুষকে তরুণ ও সজীব রাখে এখানে'', এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন টিনা আর্নট৷
শহরের কোনো এক প্রান্তে এক ইউনিটের বাড়িতে বার্ধ্যকের দিনগুলি যাপন করার কথা চিন্তাই করতে পারেন না গ্যার্ড হ্যোনশাইড গ্রস৷ ‘‘আমার স্ত্রীও এই রকম চিন্তা-ভাবনা করতেন৷ তাই আমরা সমমনাদের খুঁজতে লাগলাম, পেয়েও গেলাম৷'' সন্তানরা বড় হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, স্বামী স্ত্রী বহু প্রজন্মের এই আবাসিক কমপ্লেক্সে বসবাস করতে শুরু করেন৷
যৌথ পরিবার প্রায় দেখাই যায় না
জার্মানিতে যৌথ পরিবার প্রায় দেখাই যায় না, যেখানে নানা-নানি, মা-বাবা, নাতি-নাতনি এক সাথে বসবাস করে৷ তাই বৃদ্ধ বয়সে হয় একা বাস করা, নয়ত কোনো বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া ছাড়া গতি থাকে না অনেকের৷ এ কারণে অনেক প্রবীণই এখন বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজছেন, যেখানে নিঃসঙ্গতাও থাকবে না আবার স্বাধীনতা বজায় রেখেও চলা যাবে৷ এক্ষেত্রে বনের আমারিলিস প্রকল্প কিংবা ফ্রাইবুর্গের আলবার্ট-রিয়া-বৃদ্ধনিবাসের মতো প্রকল্পগুলি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হতে পারে৷ ফ্রাইবুর্গের বৃদ্ধাশ্রমে ছাত্র-ছাত্রীরা কম ভাড়ায় এক রুমের অ্যাপার্টমেন্ট পেতে পারেন৷ এর বদলে সপ্তাহে একদিন বর্ষীয়ান বাসিন্দাদের দেখাশোনা করতে হয় তাঁদের৷ এইভাবে তরতাজা বায়ু বয়ে যায় বাড়িটিতে৷ বৃদ্ধ ও তরুণরা পরস্পরের কাছ থেকে লাভবান হন৷
জন্মের হার কমে যাচ্ছে
জার্মানিতে জন্মের হার কমে যাচ্ছে৷ অন্যদিকে বেড়ে যাচ্ছে প্রবীণদের সংখ্যা৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির মধ্যে জার্মানিতে বয়স্কের হার সবচেয়ে বেশি৷ ইইউ-র ২০১৩ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জার্মানির ২০.৬ শতাংশ বাসিন্দার বয়স ৬৫ বছরের বেশি, আর ১৩.২ শতাংশের বয়স ১৪ বছরের কম৷
কিন্তু এই অবস্থার জন্য সেরকম প্রস্তুতি নেই৷ প্রবীণদের উপযোগী কম ভাড়ার বাসাও তেমন নেই৷ এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে আমারিলিস-এর মতো প্রকল্পগুলি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন হ্যোনশাইড গ্রস৷ এর জন্য সরকারি সহযোগিতাও প্রয়োজন৷ তবে বাস্তবায়ন করতে হবে উদ্যোগী মানুষদেরই৷
সংঘাত যে নেই তা নয়
বনের বহু প্রজন্মের আবাসনটিতে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত যে নেই, তা নয়৷ যেখানে অনেকে এক সঙ্গে বসবাস করেন, সেখানে এটা থাকবেই৷ ‘‘আমাদের এখানেও মতবিরোধ আছে৷ তবে কীভাবে এর সমাধান করা যায়, সেটাই আসল বিষয়'', বলেন হ্যোনশাইড গ্রস৷ এক্ষেত্রে আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছানোটা বিশেষ জরুরি৷ টিনা আর্নটও স্বীকার করলেন যে, কোনো কোনো দিন ‘আলোচনা' কথাটাই তাঁর আর শুনতে ইচ্ছা করে না৷ তখন তিনি দরজা বন্ধ করে রাখেন৷ টেলিফোন ও কলিং বেলও থাকে বন্ধ৷ কেউ অবশ্য বিরক্ত হয় না তাতে৷
ভাগাভাগি করার অভ্যাস
প্রথম দিকে গাড়িটা তাঁর একার নয়, এটা ভাবতে খারাপ লাগতো টিনা আর্নট-এর৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমার গাড়িটা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার অভ্যাসটা গড়ে তুলতে কিছুটা সময় লেগেছিল৷ আজ আমার কাছে এটা সঠিক বলেই মনে হয়৷ তাই গাড়ির কোথাও আঁচড় বা গুঁতোর দাগ দেখলে সেটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই না৷ আসল কথা হলো গাড়িটা চলে কিনা৷''
মাঝে মাঝে ছোটখাট দ্বন্দ্ব ও বিবাদ থাকলেও অন্য কোনোভাবে বসবাস করার কথা চিন্তা করতে পারেন না টিনা আর্নট ও হ্যোনশাইড গ্রস৷ ‘‘একঘেয়েমি নেই আমাদের এখানে৷ নিজেকে বাহুল্য মনে হয় না৷ আর সেটাই তো অর্থবহ করে তোলে জীবনকে৷'' হেসে জানান টিনা আর্নট৷