‘অযোগ্যদের' লাইসেন্স দিয়ে তো মারার লাইসেন্সও দেয়া হয়'
৬ অক্টোবর ২০২৩এই উদ্যোগ নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক।
ডয়চে ভেলে: ক্ষতিপূরণ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কতটা ভূমিকা পালন করবে? দুর্ঘটনার শিকার যারা, তারা কতটা উপকৃত হবেন?
অধ্যাপক এম শামসুল হক: এখানে যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে টাকা বন্টন করা হয়, তাহলে যারা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন , তাদের পরিবারগুলো কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। কিন্তু এই সিস্টেমটা রোড ট্রাফিকিং সিস্টেমকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে কিনা সেটা দেখার ব্যাপার।
এর কারণে রোড ট্রাফিকিং সিস্টেম ঝুঁকিপূর্ণ কেন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
কারণ, যেটা করা হচ্ছে সেটা বিজ্ঞানভিত্তিক না। রোড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, দুর্ঘটনা ম্যানেজমেন্ট এবং সিস্টেমটাকে সেল্ফ এনফোর্সমেন্ট করার জন্য, ড্রাইভারকে দায়িত্বশীল করার জন্য নানা ফিনান্সিয়াল টুলস নিয়ে গত দুই-তিনশ' বছর ধরে কাজ হচ্ছে। তার মধ্যে ইন্স্যুরেন্স একটি কার্যকর টুল। যিনি বাস মালিক বা গড়ির মালিক, তিনি ওই ইন্সুরেন্স থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারবেন। সিস্টেমটা হলো, যে গাড়ি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বা দুর্ঘটনায় বেশি পড়ে, তার প্রিমিয়াম বেশি। যেটার দুর্ঘটনা যত কম, তার প্রিমিয়াম তত কম। এর মধ্যেই কিন্তু পানিশমেন্ট এবং ইনসেনটিভ আছে। এটা পুরো পৃথিবীতে পরীক্ষিত একটা সিস্টেম। ফলে গাড়ির মালিকরা অত্যন্ত সচেতন থাকেন যে, তার গাড়ি যেন দুর্ঘটনায় না পড়ে, পড়লে তার রেটিং কমে যাবে। আমাদের এখানে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের জন্য এই ক্ষতিপূরণ একটা বরনোভেলেন্ট (উপকারী) কাজ হচ্ছে। তবে অনেক দুর্ঘটনাই আনডকুমেন্টেড থেকে যায়। ফলে ওইসব দুর্ঘটনা প্রমাণ করে ক্ষতিপুরণ পাওয়া কঠিন হবে। অথবা ‘সুযোগসন্ধানীরা' যে সুবিধা নেবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই যে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এর মধ্যেই যারা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তারা যেন ভালো হয়, সংশোধন হয় সেইরকম কোনো সিস্টেম থাকা দরকার।
এই ক্ষতিপূরণ সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে কি বাধা হবে? বিচার পাওয়াকে কি নিরুৎসাহিত করবে?
নিহত হলে তো রাষ্ট্রকে মামলা করতেই হবে। সেখানে কোনো বাধা থাকার কথা না। তবে নিরুৎসাহিত হতে পারে।
প্রচলিত আইনেও তো ক্ষতিপূরণের মামলার ব্যবস্থা আছে। আর এই ক্ষতিপুরণ অনেক বেশিও হতে পারে। কারণ, ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের নানা বিধানআছে। এখন যে পাঁচ লাখ ও তিন লাখ টাকা বেঁধে দেয়া হলো, তাতে ওই ক্ষতিপূরণ নিলে আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা বাধাগ্রস্ত হবে কিনা...
এখানে বাধা থাকবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু ক্ষতিপূরণের মামলায় বাধা থাকা উচিত হবে না। কারণ, পাঁচ লাখ টাকা আর ক্ষতিপূরণ এক না। ক্ষতি অনেক বেশি হতে পারে। সেটা আদালতই ঠিক করে দিতে পারবেন। তবে এই ধরনের মামলায় ভাটা পড়তে পারে।
আইনটির গেজেট হওয়ার আগের সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ এই আইনে হবে না। তাহলে তাদের কী হবে?
আইন হওয়ার আগে যারা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার, তাদের ক্ষতিপুরণ পাওয়ার কথা না। কারণ, আইন তো তখন ছিল না। আর বিষয়টি তো কোনো এটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। আবার আগের আরো পাঁচ বছর যুক্ত করলে তার আগের কী হবে তা নিয়েও তো তখন কথা হবে।
আমাদের তো টার্গেট সড়ক দুর্ঘটনা কমানো, জীবন রক্ষা করা। সেই লক্ষ্য অর্জনে এই ক্ষতিপুরণ কোনো ভূমিকা রাখবে ?
এই জিনিসটা ( ক্ষতিপূরণ) চালু করার কারণে আমার মনে হয় আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে সরে গেলাম। বিমা কিন্তু একটা ইনসট্রুমেন্ট। এটা সড়ক দুর্ঘটনা কমায়। ফলে সিস্টেমটা এমন হতে হবে যে এর মধ্যে পানিশসেন্ট এবং ইনসেনটিভ থাকতে হবে। এখানে তো ক্ষতিপূরণ ফান্ডে বাস ও গাড়ির মালিকরা একটা নির্দিষ্ট হারে বছরে চাঁদা দেবেন। যদি ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে হতো তাহলে লংরানে দুর্ঘটনা কমতো। কারণ, যার গাড়ি বেশি দুর্ঘটনায় পড়বে, তার প্রিমিয়াম বেশি হবে। আরেকটি বিষয় হলো, এখন যা করা হচ্ছে তাতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদেরও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
এখানে অনিয়মের সুযোগ কতটা দেখছেন?
অনিয়ম বলবো না, এখানে স্বচ্ছতার অভাব হতে পারে। কারণ, ক্ষতিপূরণ পাঁচ লক্ষ বলা হলেও সেটা পুরোটা দেয়া হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। আবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য কে হবে সেটা নির্ধারণেও অস্বচ্ছতা দেখা দিতে পারে। যারা ক্ষতিপূরণের ট্রাস্টিতে আছেন, তারা কিন্তু আমজনতার প্রতিনিধি নয়। এখানে বাস মালিকরা আছেন। তারা টাকা দিচ্ছেন, তাই তারা আছেন। ফলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সংগঠনের লোকজনের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তাহলে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক বা বাসের লোকজন, তারাও যদি আহত বা নিহত হন, তারাও কি ক্ষতিপূরণের আওতায় চলে আসবেন?
সেটাই। আমি তো সেটাই বলছি। যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, এটা তো একটা জেনারেলাইজড ব্যবস্থা। এ ধরনের ব্যবস্থা আসলে ভোঁতা। কোনো ধার নেই। তার মধ্যে যারা দায় নির্ধারণ করবেন, দেখা যাবে তারা কোনো টেকনিক্যাল পার্সন না। আবার যে দুর্ঘটনার রেকর্ড থাকবে না, সেটার রেকর্ড কিভাবে তৈরি করা হবে? এসব ক্ষেত্রে দেখা যাবে, শ্রমিক সংগঠনের কেউ হলে ক্ষতিপূরণ পাবেন। সাধারণ মানুষের ব্যাপারে উল্টো হবে। তাই এই বোনেভোলেন্ট ফান্ডের উপকারভোগী যাতে আমজনতা হয়, তার সিস্টেম নিশ্চিত করা দরকার।
তবুও একটা কিছু হলো। তারপরও রোড সেফটি, চালকদের প্রশিক্ষণ, গাড়ির ফিটনেস এগুলো নিয়ে কি তেমন কোনো কাজ হচ্ছে?
-না। আসলে যেগুলো ফান্ডামেন্টাল সেগুলো নিয়ে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। ক্ষতিপূরণ তো হলো একটা পোস্ট আউটকাম। কিন্তু আউটকামটা কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার জন্য যে কাজ সেগুলো হচ্ছে না। কমার্শিয়াল গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা না করেই ফিটনেস দেয়া হয়। চালকদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা তেমন দেখা হয় না। রাস্তায় চালানোর যোগ্যতা না দেখেই লাইসেন্স দিয়ে তো মারার লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়।
গাড়ির রুট পারমিট একটা বিজ্ঞান। হাইলি স্পেশাইজড লোক দিয়ে এটা কারাতে হয়। রুট পারমিট দেয়ার আগে গবেষণা করে দেখতে হয় কয়টি বাসকে দেয়া যাবে। কেথায় বাস স্টপেজ হবে। সেটা না করে পরিবহণ মালিকদের নিয়ে বসে এটা করা হয়। ফলে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।