ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিএনএ-টিকা
৬ ডিসেম্বর ২০১১
মানুষ অসুস্থ হলে তার রোগ প্রতিরোধের শক্তি বা ইমিউন সিস্টেম অত্যন্ত সচেতন হয়ে ওঠে৷ প্রতিরোধক কোষগুলি প্রবল বেগে রোগ জীবাণুকে বাইরের শত্রু হিসাবে শনাক্ত করতে চেষ্টা করে, তৈরি করে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি৷ এরপর জীবাণু নাশক শ্বেতকণিকা কাজে নামে, ধ্বংস করার চেষ্টা করে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে৷ এই প্রক্রিয়াটিকে আমস্টারডামের ক্যানসার ইন্সটিটিউটের গবেষক ইওন হানেন ও তাঁর সহকর্মীরা টিউমার থেরাপিতে কাজে লাগাতে চান৷ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে তাঁরা এমন অবস্থায় আনতে চান, যাতে তা ক্যানসারের কোষকে চিনতে ও ধ্বংস করতে পারে৷ ক্যানসারের কোষগুলির বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তারা কৌশলে দেহের প্রতিরোধ শক্তিকে পাশ কাটাতে পারে৷ এ প্রসঙ্গে ইওন হানেন বলেন, ‘‘আমরা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমন শক্তিশালী করতে চাই, যাতে এটি ক্যানসারের কোষকে ধ্বংস করতে পারে, বিশেষ করে টিউমার কোষের বেঁচে থাকার জন্য যে সব উপাদানের প্রয়োজন, তা বিনষ্ট করতে পারে৷''
টিউমারে সৃষ্ট প্রোটিনের অনুরূপ প্রোটিন তৈরি করা হয়
ক্যানসার কোষের বৈশিষ্ট্য হল যে, এতে সারফেস প্রোটিন সৃষ্টি হয়৷ ইওন হানেন এবং তাঁর সহকর্মীরা এই প্রোটিনের ডিএনএ টিকার মাধ্যমে সুস্থ কোষগুলিতে প্রবেশ করান৷ একটি সুঁই দিয়ে ক্যানসারের প্রোটিনের অনুরূপ, ক্ষতিকর নয় এমন প্রোটিন রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেন তাঁরা৷ কোষগুলি তখন ক্যানসারের প্রোটিনের মত প্রোটিন প্রস্তুত করতে থাকে এবং পাশের কোষেও ছড়িয়ে পড়ে৷ এই সময় প্রতিরোধ শক্তি সচেতন হয়ে ওঠে এবং এই প্রোটিনকে বাইরের কোনো বস্তু বলে চিহ্নিত করতে পারে এবং শুরু করে তাকে ঠেকাতে৷ একই প্রোটিন টিউমারের ওপরে থাকে বলে ইমিউন সিস্টেম সেটিকেও আক্রমণ করে৷ কেননা ইতোমধ্যে এই বিশেষ প্রোটিনকে বাইরের কিছু বলে চিনতে শিখেছে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা৷ প্রোটিনের ডিএনএ দেহকোষে ঢোকাবার জন্য গবেষকরা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ ‘প্লাসমিড' ব্যাবহার করেন৷ ইওন হানেন'এর ভাষায়, ‘‘আমরা প্লাসমিডে এমন জিন ঢোকাতে পারি, যা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷ এগুলি টিউমারের কোষে থাকা উপাদান হতে পারে৷ এই কাজটা কী ভাবে সম্ভব, সেটা অবশ্য পুরোপুরি আমাদের জানা নেই৷ কিন্তু দেখা গেছে শরীরের কোষগুলি এই প্লাসমিডকে গ্রহণ করে৷ এরপর প্রোটিন তৈরি করার জন্য প্লাসমিডের মধ্যে থাকা জিনের তথ্যগুলো ব্যবহার করে৷''
প্লাসমিড সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে
প্লাসমিডের একটা সুবিধা হল যে, এরা অনেকটা নমনীয় এবং সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে৷ এ ছাড়া অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় এই পদ্ধতি নির্ভরযোগ্য৷ কেননা প্লাসমিডে থাকা জিনবিষয়ক তথ্য দেহকোষের জিনোম বা কেন্দ্রস্থলে পাঠানো হয়না৷ এর ফলে প্লাসমিডের ডিএনএ কোষের মূল অংশের বাইরেই থাকে৷ এই প্রসঙ্গে ইওন হানেন জানান, ‘‘এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা না হলে জিনের সংকেতগুলি আশে পাশের অপত্যকোষ বা ডটারসেলেও ঢুকে পড়তো৷ তাই আমাদের পদ্ধতিকে অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় অনেক নিরাপদ বলা যায়৷ যেমন অনেক পদ্ধতিতে ভাইরাসের সাহায্যে জিনের তথ্য কোষের একেবার অভ্যন্তরে জিনোমে পৌঁছে যায়৷''
অন্যদিকে জেনেটিক উপাদান অপত্যকোষে না যাওয়াতে বার বার টিকা দিতে হয়৷ ইওন হানেন ও তাঁর সহকর্মীরা প্রাণীর ওপর সফলভাবে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পেরেছেন৷ বানরের ওপরও এই পদ্ধতি কার্যকর হয়েছে৷ তবে যে সব রোগীর ক্যানসার অনেকটা বেড়ে গেছে, তাঁদের ক্ষেত্রে টিউমারকে দমন করা খুব সহজ হয়নি এই পদ্ধতিতেও৷ ইওন হানেন বলেন, ‘‘আমরা জানিনা কেন এরকমটি হয়৷ ক্যানসার একটি জটিল রোগ৷ কোনো কোনো টিউমার অনেক দিন ধরে টিকে থাকে এবং এক ধরনের কৌশলের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরোধ শক্তিকে পাশ কাটাতে পারে৷ এগুলি এক ধরনের মলিকিউল তৈরি করে ইমিউন শক্তিকে নিজেদের কাছ থেকে দূরে রাখতে পারে৷''
ইওন হানেন ও তাঁর সহকর্মীরা অবশ্য আশাবাদী যে, ডিএনএ-র টিকা ভবিষ্যতে আরো কার্যকর হবে৷ তাঁরা এখন ভ্যাকসিনের ঘনত্ব বাড়িয়ে এটিকে ক্যানসারের কোষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরো সক্রিয় করতে চাইছেন৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক