কেন আমি হোমিওপ্যাথির ডাক্তার!
২৬ জুন ২০১৮হোমিওপ্যাথির সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই৷ বাবা ছিলেন সিলেট শহরের একটি নামকরা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক৷ পাশাপাশি প্র্যাকটিস করতেন হোমিওপ্যাথির৷ হাত-পা কেটে গেলে বা জ্বর, দাঁতে ব্যথা বা অন্য যে কোনো শারীরিক অসুবিধায় সোজা বাবাকেই গিয়ে বলতাম৷ বাবা ঔষধ দিতেন, খেতাম আর ভাবতাম ম্যাজিকের মতো কিছু একটা হবে আর অসুখ সেরে যাবে৷ হতোও ঠিক ঠিক তাই৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব যন্ত্রণা গায়েব৷
যত বড় হতে লাগলাম বুঝতে পারলাম মাত্র কয়েক ফোঁটা ঔষধের এত গুণ৷ এর এই জাদু দেখেই ডা. হ্যানিম্যানের সময়ের উইলিয়াম বোরিক ও কেন্টের মতো এলোপ্যাথিক চিকিৎসা জগতের বিখ্যাত ডাক্তাররা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় জড়িয়ে পড়েন৷
আমার বড় ভাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় তার বন্ধুরা তাকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেয়৷ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় এই রোগের কোনো ঔষধ নেই, শুধু ব্যথার কমাতে প্যারাসিটামল ও গ্লুকোজ স্যালাইন চলত৷
বাবা খবর পেয়ে হোমিওপ্যাথির ওষুধপত্র নিয়ে ক্লিনিকে যান৷ ডাক্তাররা এতে আপত্তি জানান৷ কিন্তু একদিন ভাইয়ের পাশের দুই বেডের রোগী একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় বাবা ডাক্তারদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে এক প্রকার জোর করেই তাকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়াতে থাকেন৷
মাত্র ১০-১৫ দিনের মাথায় সে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যায়৷ এই ঘটনায় আমার হোমিওপ্যাথির প্রতি একটা অগাধ জন্মালো৷ তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, বড় হয়ে আমিও হোমিওপ্যাথির ডাক্তার হবো৷
২০১২ সালে অনার্সে ভর্তি হবার পর হোমিওপ্যাথিক কলেজেও ভর্তি হয়ে গেলাম৷ ভর্তি হয়ে বইপত্র ঘটাতে গিয়ে বুঝলাম ম্যাজিকের পথ অনেক কঠিন৷ এক ঔষধের অনেক লক্ষণ, আবার এক লক্ষণে অনেকগুলো ঔষধ৷ তবে পড়তে অনেক ভাল লাগত৷ ফিজিওলজি, অর্গানন অফ মেডিসিন পড়তে বসে যেতাম৷ মেটিরিয়া মেডিকা নোট করতাম৷
আশ্চর্য লাগত, সত্যি সত্যি মাত্র কয়েক ফোঁটা ওষুধের এত জাদু যে ক্রনিক ডিজিজও সরিয়ে দেয়৷ তবে কিছুদিনের মধ্যেই আশ্চর্যের অবসান ঘটিয়ে হোমিওপ্যাথির প্রতি আস্থা জাগল নিজের একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে৷
পা পিছলে একবার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল মচকে গেল এবং তার হাড় ভেঙে গেল পাশের আঙুলের৷ মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন৷ ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিলেন, সাথে কিছু মেডিসিনও দিলেন৷ আমার বাবার অবশ্য একদমই তাতে সায় ছিল না৷ কিন্তু আমার যন্ত্রণা দেখে মা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধই খেতে বললেন৷ ১৫- ২০ দিন টানা খেলেও ব্যথা কমলো তো না-ই, বরং পায়ের পাতা ফুলে ফুটবল হয়ে যেতে লাগলো৷
এদিকে আমার অনার্সের পড়াশোনারও বারোটা বাজছে৷ কলেজে যাওয়া তো দূরের কথা, মাটিতে পা পর্যন্ত রাখতে পারছি না৷ বাবা বললেন, ‘‘কাজ হলে হোমিওপ্যাথিকেই হবে৷ একটা ওষুধ দিচ্ছি ১০ দিন খেয়ে দেখ৷''
লক্ষণ মিলিয়ে একটি ওষুধ দিলেন৷ বন্ধুরা যখন শুনলো আমি হাড় জোড়া লাগানোর জন্য হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাচ্ছি, আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতো৷ তারা জীবনেও শুনেনি হোমিও ওষুধ খেয়ে কারো হাড় জোড়া লেগেছে৷
আমি অবশ্য ওদের কথা পাত্তা দেইনি৷ আমার মনে হয়েছে জোড়া লাগবেই৷ হলোও তাই, মাত্র ৭ দিনেই ফোলা, ব্যথা একেবারে গায়েব৷ ৮ দিনের মাথায় বাসা থেকে কিছুটা পথ হেঁটে গিয়ে বাসে উঠে কলেজে গেলাম, সিঁড়ি ভেঙে দু'তলায় উঠে ক্লাস করলাম, অফ টাইমে লাইব্রেরিতে গেলাম, আবার হেঁটে ক্লাসে গেলাম৷ কোনো যন্ত্রণাবোধও ছিল না৷
আমার যে বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছিল তাদের দেখিয়ে বললাম, ‘‘দ্যাখ, আমার পা একদম ঠিক হয়ে গেছে, তোরা তো বিশ্বাসই করছিলি না৷ এখন দৌড়াতে দিলে তোদের আগে চলে যাব৷'' ওরাও অবাক৷ ওরাও মানতে বাধ্য হলো, সত্যিই হোমিওপ্যাথি ওষুধে ম্যাজিক আছে৷ এরপর থেকে হোমিওপ্যাথিকের প্রতি আমার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল৷
২০১৬ সালে চার বছর মেয়াদী ডি.এইচ.এম.এস এর কোর্স সমাপ্ত করে ২০১৭ সালে ইন্টার্নশিপ করি৷ এখন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে প্র্যাকটিসও করছি৷
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা একটি জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি৷সঠিক লক্ষণানুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করা বেশ কষ্টসাধ্য৷ তবে সঠিক ওষুধ দিলেও তা অনেকক্ষেত্রে অব্যর্থ হয় না৷ অনেক সময় রোগী নিজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ সংকোচ করে, ইচ্ছা করে বা অনিচ্ছাবশত ডাক্তারকে বলে না অথবা বিভ্রান্তিকর কোনো লক্ষণ উল্লেখ করে৷ এতে ডাক্তার সঠিক ওষুধ নির্বাচনে ব্যর্থ হন৷
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোনো প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং কাটা-ছেঁড়া ছাড়াই এই চিকিৎসা পদ্ধতি জটিল থেকে জটিলতর রোগ সারিয়ে দিতে সক্ষম৷
আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বাবা ও শিক্ষকদের চিকিৎসা প্রদানের পদ্ধতি দেখে বুঝতে পেরেছি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা পদ্ধতি৷
রোগীর সঠিক লক্ষণ বলতে এবং লক্ষণ সংগ্রহ করে ঔষধ নির্বাচনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তারের ব্যর্থতা থাকতে পারে, তবে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের কোনো ব্যর্থতা নেই৷ বরং অন্যান্য প্যাথির তুলনায় জটিল ও পুরাতন রোগের চিকিৎসায় এটি অধিক কার্যকর৷
অর্পিতা দেব কানুনজ্ঞ-র লেখাটি আপনাদের কেমন লাগলো? লিখুন নীচের ঘরে৷