কেন আমি বিমানে চড়ি না?
১৯ ডিসেম্বর ২০১৬বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ২০০৬ সালে৷ কাঠমান্ডু গিয়েছিলাম একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে৷ ঢাকা থেকে ঠিকঠাকই ছেড়েছিল বিমান৷ খাবারও বেশ ভালো ছিল৷ গোল বাধঁলো ফিরতে ফ্লাইটে৷ টানা কয়েকদিন প্রশিক্ষণে ক্লান্ত ছিলাম৷ কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে তাড়াহুড়ায় পৌঁছাতে গিয়ে ঠিকভাবে খাওয়া হয়নি৷ কিন্তু বিমানবন্দরে ‘চেক ইন' করে বহির্গমন বিভাগে পৌঁছে দেখি বিমান তিনঘণ্টা ‘লেট'৷ কোনোমতে ক্ষুধার্ত পেটে অপেক্ষা করে বিমানে উঠলাম৷ আশা ছিল, অন্তত দুপুরের খাবারটা পাবো৷ ও মা, ছোট্ট একটা স্যান্ডউইচ আর কোমল পানীয় মিললো৷ অন্য কোনো খাবার আছে কিনা জানতে চাইলে একজন ‘কেবিন ক্রু' সাফ বলে দিলেন, নেই৷ বিমান ছোট, তাই খাবার যা আনা হয়েছিল তা নাকি আগের ফ্লাইটে শেষ হয়ে গেছে! এক টুকরো পেস্ট্রি সম্ভবত মিলেছিল পরে৷ কিন্তু তাতে কি আর ক্ষুধা মেটে!
ফ্লাইটে পয়সা দিয়েও খাবার কেনার জো ছিলে না তখন৷ তাই ঢাকা ফিরতে হয়েছে খালি পেটেই৷ বাংলাদেশ বিমানে প্রথম যাত্রাটার খাবারের কষ্টের অভিজ্ঞতা ভুলতে পারি না৷ সম্ভবত সেবছরই আরেক সম্মেলনে যাই আগ্রাতে৷ ফিরতি ফ্লাইট ছিল বিমানে, নতুন দিল্লি থেকে ঢাকা৷ সেবারও বিমান ছেড়েছিল অন্তত আড়াই ঘণ্টা পরে৷ আর ফিরতে পথে পেপসির বড় বোতল হাতে একজনকে দেখেছিলাম যাত্রীদের কোমল পানীয় সরবরাহ করতে৷ তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন, ঘামার্ত শরীরে কোনোরকম কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন শাড়ি পরা বয়স্ক ভদ্রমহিলা৷ এরকম কেবিনক্রু আমি অন্য কোনো বিমানসংস্থায় দেখিনি৷ তাই আজও তাঁর কথা মনে পড়ে৷
গত একযুগে এশিয়া, ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে গেছি৷ এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিমান সংস্থার সেবা নেয়ার সুযোগ হয়েছে৷ ক্রমশ পছন্দের তালিকায় সবার উপরে উঠে গেছে এমিরেটস এয়ারলাইন্স৷ এর কয়েকটি কারণ আছে৷
প্রথমত, এমিরেটস-এর ‘ফ্লাইট সিডিউল' পুরোপুরি ঠিক রাখে৷ এখন অবধি একবার তীব্র তুষারপাতের কারণে ফ্লাইট বাতিল হওয়া ছাড়া কোনো ফ্লাইটই ‘ডিলে' হয়নি, অন্তত আমার সঙ্গে৷
দ্বিতীয়ত, এমিরেটস ‘কমিটমেন্ট' ঠিক রাখে৷ তাদের কোনো ভুল হলে যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তা সংশোধনের চেষ্টা করে৷
তৃতীয়ত, এমিরেটস-এর ‘ইনফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট' ব্যবস্থা এক কথায় সবার চেয়ে সেরা৷
চতুর্থত, এমিরেটস-এর খাবারের মান অসাধারণ৷
পঞ্চমত, বিমানগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন এবং ভালোভাবে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়৷
বলাবাহুল্য, ওপরের এই কারণগুলোর কোনোটিই বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে এখন আর প্রযোজ্য নয়৷ অথচ এই বিমানের প্রশংসা শুনেছিলাম আমার একজন বর্ষীয়ান জার্মান সহকর্মীর কাছে৷ নব্বইয়ের দশকে এশিয়ায় অনেকবার ভ্রমণ করেছেন তিনি৷ সেসময় বিমানে চড়েছিলেন কয়েকবার৷ তিনি জানান, বাংলাদেশ বিমান তাঁর খুব ভালো লাগতো৷
তাঁকে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা অবশ্য বলিনি৷ দেশের কোনো কিছুর সুনাম শুনলে বরং ভালোই লাগে৷ গতবছর ফ্রাংকফুর্ট থেকে ঢাকা বিমানের ফ্লাইট চালু হওয়ায় তাই নতুন করে বিমান যাত্রা করতে চেয়েছিলাম৷ দেশপ্রমের কারণেই আগ্রহটা জেগেছিল৷ কিন্তু আমার সেই আশা ভঙ্গ হলো অচিরেই৷ জানলাম, বিমানের ফ্লাইটটি বন্ধ হয়ে গেছে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই৷ আর যে কয়মাস চলেছিল, তাতে খুব একটা সুখ্যাতিও কুড়াতে পারেনি বিমান৷ শুরুতে ফলাও করে প্রচার করা নতুন বোয়িং বিমান অল্প ক'দিন সেবা দিয়েই হাওয়া হয়ে গেছে৷ তার বদলে মিশরের এক ভাড়া বিমান দিয়ে ফ্রাংকফুর্ট টু ঢাকা ফ্লাইট চালু রাখা হয়েছিল কিছুদিন৷ যাঁরা সেই বিমানে চড়েছেন, তাঁরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন৷ আশ্চর্যের বিষয় ছিল, অন্যান্য বিমানের তুলনায় অর্ধেক ভাড়া নিয়েও, ফ্লাইটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন খালি থাকতো রুটটিতে৷ সম্ভবত, মার্কেটিংয়ে ঘাটতি ছিল৷
এখন যেভাবে বিমান চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে এর কোনো ভবিষ্যত আছে বলে আমার মনে হয় না৷ তবে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিমান সেবায় বাংলাদেশের ভালো করার একটা সুযোগ এখনো আছে৷ তাই প্রয়োজন বিমানের সেবার মান অনেক ভালো করা, ‘ফ্লাইট সিডিউল' ঠিক রাখা আর অবশ্যই নিজেদের ‘রিপুটেশন' ভালো করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা৷ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিমান আদৌ সেটা পারবে কিনা, সেটা অবশ্য ভালো প্রশ্ন৷
বাংলাদেশ বিমানে কখনো ভ্রমণ করেছেন? জানান আপনার অভিজ্ঞতা৷