কেন্দ্রীয় বাজেটের ‘মিষ্টি' প্রকল্পে সংকট ঘুচবে সুন্দরবনের?
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বুধবারের বাজেটে পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্পের ঘোষণা করেন। নজর কেড়েছে তার ‘মিষ্টি' প্রকল্প। এর পোশাকি নাম ম্যানগ্রোভ ইনিশিয়েটিভ ফর শোরলাইন হ্যাবিট্যাটস অ্যান্ড ট্যাঞ্জিবল ইনকাম (এমআইএসএইচটিআই)। লক্ষ্য, ম্যানগ্রোভের সাহায্যে জলবায়ু রক্ষা।
পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে রয়েছে বিশ্বের সবথেকে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ৪০ শতাংশ। শুধু ভারত বা বাংলাদেশে নয়, পৃথিবী জুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সঙ্কুচিত হচ্ছে। ব্লু কার্বন ইনিশিয়েটিভ-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, গত পাঁচ দশকে ৩০-৫০ শতাংশ ম্যানগ্রোভ হারিয়েছে পৃথিবী থেকে। বছরে দুই শতাংশ হারে তা কমছে। এর ফলে কী ক্ষতি হবে? ম্যানগ্রোভ উচ্চ হারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এই অরণ্য না থাকলে বাতাসে দূষণ বাড়বে। এর সঙ্গে উপকূলে ভূমিক্ষয়, ঝড়ে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা, পরিবেশ রক্ষার জন্য উপকূল বরাবর ম্যানগ্রোভ রোপণ ও সংরক্ষণে নজর দেবে কেন্দ্র। এর জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে। প্রকল্প সম্পর্কে ম্যানগ্রোভ গবেষক অধ্যাপক আশিসকুমার পালের মন্তব্য, "গত দু-তিন বছর ধরে সুন্দরবনে প্রচুর ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে। সমীক্ষায় দেখেছি, সেগুলি ভাল জায়গাতেই আছে। মিষ্টি প্রকল্প কার্যকর হলে বাস্ততন্ত্রের ক্ষতি হবে না। স্থানীয় অর্থনীতিও উপকৃত হবে।”
ম্যানগ্রোভ রোপণের উদ্যোগ আগেই নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সীতারামনের ঘোষণায় পরিবেশকর্মীরা খুশি, তবে একই সঙ্গে সংশয়ীও। পরিবেশকর্মী নব দত্ত বলেন, "সিদ্ধান্তটা ভাল, কিন্তু কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মুখ্যমন্ত্রী পাঁচ কোটি গাছ লাগানোর কথা বলেছেন, কে গুনেছে? যত গাছ পোঁতা হয়, তার থেকে বেশি কাটা হয় কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রকল্পের নামে।”
সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ নষ্ট করে মাছের ভেড়ি তৈরির অভিযোগ উঠেছে বারবার। বাদাবন কেটে জ্বালানির কাজে লাগানো হচ্ছে। বনসৃজন প্রকল্পে বিভিন্ন পঞ্চায়েত ম্যানগ্রোভ লাগালেও নজরদারির অভাবে তা রক্ষা করা যাচ্ছে না। এর থেকে মুক্তির উপায় কী?
রাজ্য জীববৈচিত্র্য পর্ষদের চেয়ারম্যান হিমাদ্রীশেখর দেবনাথ বলেন, "ম্যানগ্রোভ কেটে ইটভাটা তৈরির কাজ বন্ধ করা হয়েছে। তবে যেসব চিংড়ি-কাঁকড়ার ভেড়ি হয়েছে, তা সরালে জীবিকার উপর আঘাত আসবে। তাই যতটুকু অরণ্য আছে, সেটার রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।”
সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ রোপণকারী উমাশঙ্কর মণ্ডল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ম্যানগ্রোভ রক্ষায় মানুষের নজরদারি, সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনের আন্তরিকতা দরকার। গজিয়ে-ওঠা ভেড়িগুলোর চারপাশে গর্জন, ক্যাওড়ার মতো ম্যানগ্রোভ লাগানো হোক। ম্যানগ্রোভ অ্যকোয়া ফার্ম তৈরি করেও হৃত পরিবেশ ফেরত পাওয়া যাবে।”
২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ রুখতে ‘মিষ্টি' প্রকল্প যেখানে কেন্দ্রের ভরসা, বিশেষজ্ঞদের সংশয় প্রকল্পের রূপায়ণ নিয়ে। বাজেট ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও সমুদ্রবিজ্ঞানী তুহিন ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যা ম্যানগ্রোভ লাগানো হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই বাঁচে না। কোন চরে, কোন বাঁধে কী গাছ লাগাব, তার সমীক্ষা দরকার। এটা ব্যবসার আকার নিয়েছে, লাভ হচ্ছে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার।”
কিন্তু রাজনীতিই কি পরিবেশের শত্রু হয়ে উঠছে? পরিবেশ আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী সুভাষ দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বরাদ্দটা বড় নয়, ম্যানগ্রোভ বাঁচানোর চেষ্টা জরুরি। কিন্তু ভোটের জন্য জনবসতি গড়া হলে ম্যনগ্রোভ বাঁচবে কী করে?”
পরিবেশ আদালত থাকলেও তাতে ভরসা নেই সুভাষের। তিনি বলেন, "নির্দেশ দিয়েই দায় সারলে হবে না। আদালতকে নজরদারি করতে হবে তার রায় কার্যকর করার জন্য।”