কেন্দ্রীয় তদন্তের ত্রিফলার মুখে তৃণমূল
২৩ মার্চ ২০২৪দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ইডি গ্রেপ্তার করার পর তুমুল হইচই শুরু হয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর হওয়ার পর এই হাই প্রোফাইল গ্রেপ্তারি। সমালোচনার মধ্যে ক্রমশ তৎপরতা বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি। সিবিআই, ইডি ও আয়কর দপ্তর, এই তিন কেন্দ্রীয় সংস্থা তৎপর পশ্চিমবঙ্গে।
মন্ত্রীর বাড়িতে ইডি
বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল দীর্ঘদিন তিহার জেলে বন্দি। এই জেলার সিনিয়র তৃণমূল নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী এবার কেন্দ্রীয় সংস্থার নজরে।
শুক্রবার বোলপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের বাড়িতে দিনভর তল্লাশি চালায় ইডি। সকাল পৌনে ন'টা নাগাদ সংস্থার আধিকারিকেরা চন্দ্রনাথের বোলপুরের বাড়িতে যান। ম্যারাথন তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত।
স্কুলে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় সংস্থার এই অভিযান। এই মামলায় জেলবন্দি বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের হেফাজত থেকে চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে শখানেক প্রার্থীর আবেদনের সঙ্গে চন্দ্রনাথের যোগ পাওয়া গিয়েছে বলে ইডি সূত্রের দাবি।
সংস্থার সূত্রে দাবি, প্রায় ৪১ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে মন্ত্রীর বাড়ি থেকে। নির্বাচনের মুখে এত নগদ টাকা কেন বাড়িতে এই প্রশ্নের সদুত্তর মন্ত্রী দিতে পারেননি বলে দাবি করা হচ্ছে। এই টাকার সঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতির কোনো যোগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ইডি জানিয়েছে, মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বেশি কিছু নথিও উদ্ধার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তার একটি মোবাইল। সেই মোবাইল খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে খবর।
অভিযান শেষে মন্ত্রী বলেন, "আধিকারিকরা আমার কাছে যা জানতে চেয়েছেন, যতটা সম্ভব তার উত্তর দিয়েছি। তদন্তে সহযোগিতা করেছি।"
লোকসভায় তৃণমূলের সাবেক সাংসদ মহুয়া মৈত্র। প্রশ্নের বিনিময়ে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগে তার সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যায়। তাকে ফের নদিয়ার কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে টিকিট দিয়েছে তৃণমূল। সেই প্রার্থী এখন সিবিআই নজরে।
আজ সকাল সাতটার কিছু পরে দক্ষিণ কলকাতার আলিপুরে একটি ফ্ল্যাটে হানা দেন সিবিআই আধিকারিকরা। নিরাপত্তারক্ষীদের দাবি, ওই ফ্ল্যাটটির মালিক ডিএল মৈত্র। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। সম্পর্কে মহুয়া মৈত্রের বাবা।
‘রত্নাবলী' নামের একটি আবাসনে রয়েছে ফ্ল্যাটটি। কেন্দ্রীয় বাহিনী গোটা আবাসন ঘিরে ফেলে। দুপুর পর্যন্ত ফ্ল্যাটে তল্লাশি চলে।
তবে ঠিক কী কারণে অভিযান, তা তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। অনুমান করা হচ্ছে, টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন করার অভিযোগের সঙ্গে এর যোগ রয়েছে।
মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রথম এই অভিযোগ তুলেছিলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তিনিই তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে স্পিকারকে চিঠি লেখেন। লোকপালকেও তিনি অভিযোগ জানান।
দুবের অভিযোগের ভিত্তিতেই মহুয়ার বিরুদ্ধে এথিক্স কমিটিকে তদন্তের নির্দেশ দেন লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা। তদন্তের পর এথিক্স কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মহুয়াকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এখানেই বিষয়টিতে ইতি পড়েনি। তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন লোকপাল। আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দিতে বলেন। মহুয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে মামলা করতে বলেন লোকপাল।
সেই নির্দেশ মতো মহুয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর করে সিবিআই। আর তার পরই এই তল্লাশি। নিরাপত্তা রক্ষীদের বক্তব্য, মহুয়াকে এই ফ্ল্যাটে আসতে তারা দেখেননি। এখান থেকে কিছু নথি বাজেয়াপ্ত করেছে সিবিআই।
কলকাতার তল্লাশি শেষ হওয়ার পর কৃষ্ণনগরে মহুয়ার সংসদীয় কার্যালয়ে পৌঁছয় সিবিআই। এখানে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কার্যালয় চালান সাবেক সাংসদ। যদিও তিনি থাকেন নদিয়া জেলারই করিমপুরে।
মন্ত্রীর ভাই আয়কর নজরে
কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থার নজির গড়া, দীর্ঘ তল্লাশি অভিযানের সাক্ষী রইল কলকাতা। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাইয়ের বাড়িতে তিন দিন ধরে একটানা তল্লাশি চালালো আয়কর দপ্তর।
বিদ্যুৎ এবং ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রীর ভাই স্বরূপ বিশ্বাস টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র কর্মীদের সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ কর্তা। তার স্ত্রী জুঁই বিশ্বাস কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর।
গত বুধবার থেকে তাদের বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে আয়কর দপ্তর। আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ বিশ্বাসদের বাড়ি ছাড়েন আধিকারিকরা। টানা প্রায় ৭২ ঘণ্টা ধরে চলে এই অভিযান।
প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা স্বরূপের আয়ের উৎস খুঁজে দেখতে এই অভিযান বলে দপ্তর সূত্রের খবর। স্বরূপ ও তার স্ত্রী দফায় দফায় আধিকারিকদের জিজ্ঞাসাবাদে মুখে পড়েছেন। প্রয়োজনীয় নথি দেখাতে হয়েছে তাদের।
আয়কর দপ্তর স্বরূপ বিশ্বাসকে আগামী মাসের গোড়ায় তলব করেছে। কিছু নথিপত্র নিয়ে আধিকারিকদের কাছে আসতে বলা হয়েছে তাকে।
স্বরূপের বক্তব্য, "নির্বাচনের মুখে বিরোধী দলের নেতা, কর্মীদের হেনস্থা করতেই এই অভিযান। আমার বাড়িতে কিছু পায়নি। খালি হাতে ফিরতে হয়েছে আয়কর দপ্তরকে।" বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "কোনো প্রতিহিংসা নয়। আয়কর দপ্তর দেশজুড়ে এ ধরনের অভিযান চালায়।"
তৃণমূলের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় সংস্থার ধারাবাহিক তদন্ত চলছে।বিজেপি তো বটেই, এই তৎপরতাকে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যের বিরোধী বাম ও কংগ্রেস। এর পাশাপাশি কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি তৃণমূলকেই নির্বাচনের আগে সুবিধা করে দেবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, "তৃণমূল এখন উদাহরণ দিতে পারবে, সিপিএম যে আপ নেতাকে সৎ বলে, তিনি জেলে গিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূলের নেতা জেলে গেলে তারা বলছে অসৎ। আবার বিজেপি বিরোধী জোটে লালুপ্রসাদ যাদবের সঙ্গে থাকতে তাদের অসুবিধা নেই, কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে থাকতে সমস্যা। সিপিএম কেন দুটিকে আলাদা চোখে দেখছে, এই প্রচারের অস্ত্র হাতে পেয়ে গেল তৃণমূল।"