বিশ্ব উষ্ণায়ন
২০ এপ্রিল ২০১২কারাকোরাম পর্বতমালা৷ বিশ্বের বৃহত্তম গ্লেসিয়ার অঞ্চলগুলির মধ্যে একটা৷ দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গও রয়েছে তার দখলে৷ যেমন কে টু৷ কারাকোরামের সবচেয়ে উঁচু এই কেটু পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের ঠিক পরেই অবস্থান করছে গোটা বিশ্বে৷ ফরাসি গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল জানিয়েছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে সেই সুদূর গ্রিনল্যান্ড বা অ্যান্টার্কটিকায়, অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে জানেমানে গ্লেসিয়ার অঞ্চলের বরফ যেখানে গলছে প্রতি বছরই, সেই অনুপাতে কারাকোরামের বরফকে কিন্তু ততটা টলাতে ব্যর্থ এখনও এই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং৷
কারাকোরামের অবস্থানটার বিষয়ে আগে একটু স্পষ্ট একটা ধারণা দেওয়া যাক৷ ভারত, চীন আর পাকিস্তানের কিছুটা সীমানা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই পর্বতমালা৷ যার অধিকাংশ এলাকাই দুর্গম, কোথাও কোথাও নো-ম্যানস ল্যান্ড, অর্থাৎ ভারত পাকিস্তানের সীমানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, রয়েছে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের দুর্ভেদ্য বরফাবৃত অঞ্চলের অনেকখানি এই কারাকোরামের মধ্যেই৷ যেখানে মানুষের পায়ের চিহ্ন এখনও পড়েনি, এমন এলাকাও রয়েছে৷ আর এর সবটাই বরফের চাদরে মোড়া৷
কারাকোরাম পর্বতমালার বিস্তীর্ণ এলাকার অনেকটাতেই রয়েছে গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ৷ এই যে গ্লেসিয়ার, এ হল গোটা বিশ্বের মোট বরফের মাত্র তিন শতাংশ৷ একটি গ্রহের অনুপাতে সেটা কিন্তু অনেকখানি৷ সেই তিন শতাংশ হিমবাহ অঞ্চলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে অনেকদিন ধরেই চলছে আলোচনা৷ কিন্তু যেহেতু এই পর্বতমালার অধিকাংশ এলাকাই দুর্ভেদ্য, কিছু এলাকা রাজনৈতিক কারণে অগম্য, তাই গবেষণার চেষ্টা চললেও সেটাকে বাস্তবায়িত করতে সময় লেগেছে অনেক৷
তবুও ‘বেটার লেট দ্যান নেভার'৷ একদল ফরাসি গবেষকদল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বের করে ফেলেছেন একটি রাস্তা৷ আর তাতেই জানা গেছে কারাকোরামের হিমবাহের ওপর বিশ্ব উষ্ণায়ন ততটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি, যতটা সে পেরেছে অ্যান্টার্কটিকা বা গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহের ওপর৷
এবার দেখা যাক কিছু পরিসংখ্যানগত হিসেবনিকেশ৷ কারাকোরাম পর্বতমালাই শুধু নয়, হিমালয় পর্বতমালার পুরো যে বরফ, গত কয়েক দশক ধরে লাগাতার তার পরিসংখ্যান দেখে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে একমাত্র এই এলাকার হিমবাহের ক্ষেত্রেই বরফ কমে যাওয়া নয়, দেখা যাচ্ছে সামান্য হলেও বরফের পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটেছে৷ দক্ষিণ পূর্ব ফ্রান্সের গ্রেনোবেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যে গবেষণাটি চালিয়েছেন উপগ্রহ থেকে পাওয়া ত্রিমাত্রিক ছবি আর মানচিত্রের ভিত্তিতে, তাতে দেখা গেছে, ২০০ সাল থেকে ২০০৮ সাল, এই সময়সীমার মধ্যে, হিমালয় এবং সন্নিহিত অঞ্চলের হিমবাহের বরফের পরিমাণ প্রতি বছরে ০.১১ মিলিমিটার করে বাড়ছে৷ ইঞ্চির মাপে যার পরিমাণ হল ০.০৪ ইঞ্চি৷
এই সংবাদটি তো অবশ্যই ইতিবাচক৷ ইতিবাচক এই কারণেই যে বিশ্বের অন্যত্র যেখানে বরফ গলে যাচ্ছে, হিমবাহের মাপ আসছে ছোট হয়ে আর তার ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য অরক্ষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, সেখানে হিমালয় অন্তত শোনাচ্ছে সামান্য হলেও আশার বাণী৷
গ্রেনেবোল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দলের প্রধান জুলি গার্ডেলে সংবাদসংস্থা এএফপি-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পুরো পরিস্থিতির বিশদ একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ জুলি জানাচ্ছেন, কারাকোরাম পর্বতমালার যে অংশ পাকিস্তানের ইন্দাস নদীর সীমানা থেকে শুরু হয়ে চীনের ইয়ারকান্ত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই পুরো এলাকার হিমবাহের একটা বিশদ পর্যবেক্ষণ তাঁদের গবেষকরা চালিয়েছেন৷ এই পুরো এলাকার পরিমাপ হল মোট ৫,৬১৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা৷ তার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই নেচার জিওসায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রবন্ধ৷ যে প্রবন্ধ জানাচ্ছে কারাকোরামের সম্পর্কে সুসংবাদ৷
তবে কারাকোরামের হিমবাহ অঞ্চলে বিশ্ব উষ্ণায়ন তার প্রভাব সেভাবে তৈরি করতে না পারলেও, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সীমানা নিয়ে যে সিয়াচেন বিতর্ক, সেই সিয়াচেনের পরিস্থিতি মোটেই সুবিধার নয়৷ ইনস্টিট্যুট অব ইসলামাবাদের অধীনে টেঁকসই উন্নয়ন বিষয়ক প্রকল্পের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত ৩৫ বছরে সিয়াচেনের উচ্চতা ১০ কিলোমিটার কমে গেছে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই উঁচু এলাকার উচ্চতা এতটা কমে আসা খুব একটা সুসংবাদ আদৌ নয়৷ সুতরাং, বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠিকই তলায় তলায় তার কাজ করে চলেছে৷ কারাকোরামের ক্ষেত্রে তার প্রভাব এখনও শুরু হয়নি বটে, তবে হতে কতক্ষণ? কারণ, পরিবেশের জন্য শুভ নয়, অশুভটাই মানুষ করে চলেছে বেশি যে!
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, এএফপি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ