কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে আইনি বিতর্ক
৬ নভেম্বর ২০১৪এদিকে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন কামারুজ্জামানের দণ্ড কার্যকর করতে প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷
সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায় দেন সোমবার৷ সেসময় রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করে, ট্রাইবুন্যাল আইন যেহেতু বিশেষ আইন, তাই রিভিউয়ের সুযোগ না থাকায় তাঁর মৃত্যুদণ্ড যে-কোনো দিন কার্যকর হতে পারে৷ আর কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা দাবি করেন রিভিউয়ের অধিকার সাংবিধানিক৷ তাই এই অধিকার বাতিল করা যায় না৷
বৃহস্পতিবার কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনিরসহ কয়েকজন আইনজীবী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করে মামলার বিষয়ে কথা বলেন৷ এরপর মনির জানান, ‘‘আপিলের রায়ের কপি হাতে পেলে রিভিউ করার আবেদন করা হবে৷ রিভিউ খারিজ হলে মারসি পিটিশন (রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা) করা হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷''
দণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি এবং রিভিউ আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের সমালোচনা করে অ্যাডভোকেট শিশির বলেন, ‘‘তাঁরা আইনের লোক হয়ে এ ধরনের কথা বলতে পারেন না৷ কাদের মোল্লার আপিলের রায় ঘোষণার দুই মাস সাত দিন পর পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পেয়েছি৷ তারপর ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল৷'' তিনি প্রশ্ন করেন,‘‘কামারুজ্জামানের বেলায় এতো তাড়াহুড়া করা হচ্ছে কেন৷'' শিশির বলেন, ‘‘রিভিউ আবেদন একটি সাংবিধানিক অধিকার৷ কামারুজ্জামানকে এই অধিকার দিতে হবে৷''
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘‘রায় কার্যকর করতে পূর্ণাঙ্গ নাকি সংক্ষিপ্ত রায় দরকার হবে, তার সিদ্ধান্ত আপিল বিভাগের৷ তবে আমার মত হচ্ছে সংক্ষিপ্ত রায়েই কার্যকর করা যাবে৷'' তিনি বলেন, ‘‘ট্রাইবুন্যাল কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন৷ আর আপিল বিভাগ তা বহাল রেখেছেন৷ সুতরাং বহালের বিষয়টি কারা কতৃপক্ষ জানলেই হলো৷ এখানে বিস্তারিত দেখার কিছু নেই৷ রিভিউয়ের কোনো সুযোগ নেই৷''
মাহবুবে আলম বলেন,‘‘কাদের মোল্লা আর কামারুজ্জামানের বিষয় এক নয়৷ একটু পাথর্ক্য আছে৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড হয়৷ আর কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে দুই আদালত একই রায় দিয়েছেন৷''
ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া
এদিকে ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিধান নিয়ে কারাগারের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে একটি ধারণা পাওয়া গেছে৷ কারাবিধি অনুযায়ী বিচারিক অঞ্চলের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ ঘোষণার দিনই আদেশ সম্পর্কে জানাতে হবে৷ আদেশ জানার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রায় সম্পর্কে জানাবেন কারা কর্তৃপক্ষকে৷
আপিল আদালতের রায় ও আদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পৌঁছাতে হবে৷ রায় ও আদেশ পাওয়ার পর অপরাধ ট্রাইবুন্যাল আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন৷ এরপর মৃত্যু পরোয়ানা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারাগারে পৌঁছাতে হবে৷ কারা কর্তৃপক্ষ মৃত্যু পরোয়ানা আসামিকে পড়ে শোনাবেন৷
আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন৷ তবে এটি চাইতে হবে রায় ঘোষণার সাত দিনের মধ্যে৷ কোনো কারণে আসামি সাত দিনের মধ্যে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে না পারলেও পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে সেটি করতে পারবেন৷ অর্থাৎ রায় ঘোষণার ২১ দিনের মধ্যে যে-কোনো আসামি প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন৷
তবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার পর রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত কারা কর্তৃপক্ষ রায় কার্যকর করতে পারবে না৷
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে৷ কারা কর্তৃপক্ষ প্রাণভিক্ষার আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে৷ এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটি পাঠাবে রাষ্ট্রপতির কাছে৷ রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও আসবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে৷ রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারা কর্তৃপক্ষকে জানাবে৷
কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে৷ তবে রাষ্ট্রপতি কিংবা সংশ্লিষ্ট আদালত রায় স্থগিত করলে রায় কার্যকর করাও স্থগিত হবে৷
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখার বিষয়টি কামারুজ্জামানকে জানানো হয়েছে৷ আর কারা কর্তৃপক্ষকে জেলকোড অনুযায়ী দণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ তিনি জানিয়েছেন প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য কামারুজ্জামান সাত দিন সময় পাবেন৷ আর এই দিন গণনা শুরু হয়েছে তাকে প্রাণদণ্ডের আদেশ জানানোর দিন থেকে৷ তবে তাঁকে কি প্রক্রিয়ায় দণ্ডের বিষয়টি জানানো হয়েছে তা স্পষ্ট করেননি আইনমন্ত্রী৷ তাঁর মতে, ‘‘পূর্ণাঙ্গ রায় নয়, সংক্ষিপ্ত রায়ের লিখিত কপি থেকেই রায় কার্যকর করা যাবে৷''
কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মনির আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘এখনো রায়ের শর্ট অর্ডারই (সংক্ষিপ্ত আদেশ) বের হয়নি৷ বিচারপতিদের সিগনেচার সম্বলিত কোনো অর্ডার কারও কাছে পৌঁছায়নি৷ তাই আইনমন্ত্রী রায় কার্যকর করার প্রস্তুতির নির্দেশ দিতে পারেন না৷ আর সুপ্রিম কোর্টের রুলসে আছে রিভিউ আবেদনের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি সংযুক্ত করতে হয়৷''
এই মামলায় আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘‘পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে৷ রায় পেলে রিভিউ আবেদন দাখিল করা হবে৷ এর আগে রায় কার্যকর করা আইনসম্মত হবে না৷'' তিনি বলেন, ‘‘আপিলে বিভক্তি রায় এসেছে৷ তাই রিভিউ আবেদন করা আরো বেশি জরুরি৷''