চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন!
১৮ জুলাই ২০১৭বাংলাদেশের বিদ্যুতের ইতিহাসে একটি আলোচিত নাম ‘কানসাট'৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্যুতের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়৷ এরপর এপ্রিল মাসে সেই আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়৷ ঐ আন্দোলনে জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত এবং শতাধিক আহত হয়৷ আন্দোলনটির নেতৃত্ব দেন গোলাম রব্বানি৷ একই সময়ে ঢাকার শনির আখড়ায় বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে সহিংস বিক্ষোভ করেন নগরবাসী৷ বিক্ষোভের মুখে তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য সালাহউদিন আহমেদ পালিয়ে যান৷ এই দু'টি আন্দোলনের সময়ই বিএনপি ছিল শাসন ক্ষমতায়৷ বিদ্যুৎ নিয়ে আন্দোলন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলে৷ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাই বিদ্যুৎ ছিল একটি প্রধান ইস্যু৷ ঐ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতাহারে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা বলেছিল৷
কানসাট আন্দোলনের বছর ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট৷ আর বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৪২০০ মেগাওয়াট৷ এখন, মানে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে, প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বাংলাদেশে গড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট৷ সরকার বলছে, এখন চাহিদার সমান বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়৷ অর্থাৎ কোনো ঘাটতি নেই৷ প্রধানমন্ত্রী ২১ জুন জাতীয় সংসদে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সবার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে মোট ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে৷ এছাড়া চলতি ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়তি ১৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে৷
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এর আগে ১১ জুন সংসদে জানান, বর্তমানে মোট ১১ হাজার ৩৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে৷ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে৷
বর্তমানে মোট ৪ হাজার ৯১৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷ এ সব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে৷ বর্তমানে মোট ৬ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে৷
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করা হয় গ্রাহক সংখ্যার ভিত্তিতে৷ এবছরের জুন মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি ৪৯ লাখ৷ দাবি করা হয়, দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ এ মুহূর্তে বিদ্যুতের সুবিধার আওতায়৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরাসরি কত মানুষ বিদ্যুৎ পান? আর যারা পান, তারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পান কিনা৷ গ্রীষ্মকালে খোদ ঢাকা শহরেই এবার ‘লোডশেডিং' চরমে উঠেছিল৷ শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা দিয়ে হিসাব করলেও বিভ্রান্তি বাড়বে৷ বছরজুড়ে ‘পিক আওয়ার' কোনটি – এ প্রশ্নের উত্তর হবে গ্রীষ্মকাল৷ ঢাকার বাইরে নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়নি কখনোই৷ এখনো পাওয়া যায় না৷ কানসাট-এর মতো বড় কিছু না হলেও, বিদ্যুতের দাবিতে এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে মিছিল বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়৷ তবে সরকার এর ব্যাখ্যা দিচ্ছে অন্যভাবে৷ সরকার বলছে, সঞ্চালন লাইনের ত্রুটির কারণেও কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হয়৷
আরেকটি কথা হলো, কত মানুষের বিদ্যুৎ সংযোগ আছে? এ কথা সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ এখনও বিদ্যুতের সংযোগ চেয়ে পাননি৷ বহু জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার সুবিধাই এখনো হয়নি৷ বাস্তবতা হলো, এই মাপকাঠি অনুযায়ী নাগরিকসহ আবাসিক, বাণিজ্য খাত ও শিল্প মিলে যাদের সংযোগ আছে, তাদের সকলকে বিদ্যুৎ দিতে এই মূহূর্তে ১০ হাজার ৫০০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন৷ এর অর্থ, যারা এখনও সংযোগ সুবিধার আওতায় আসেননি তাদের একটা আনুমানিক চাহিদা হিসাব করলে বিদ্যুতের চাহিদা আরো বাড়বে৷
৮০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থাকার মানে, দেশের ৮০ ভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ লাইন গেছে৷ এর মানে এই নয় যে, ঐ ৮০ ভাগ মানুষই বিদ্যুৎ পাচ্ছেন বা সবার বিদ্যুৎ সংযোগ আছে৷ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা যায় যে, বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া গ্রাহকের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫ ভাগের বেশি হবে না৷ সম্প্রতি প্রকাশিত ‘রিনিউয়েবলস ২০১৭ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট' অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬ কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছেন৷
সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র ১০৯টি৷ এরমধ্যে ৩টি দীর্ঘমেয়াদে মেরামতের জন্য বন্ধ আছে৷ উৎপাদনে আছে ১০৬ টি৷ এরমধ্যে গ্যাসভিত্তিক ৫৭টি, তেল ভিত্তিক ৪৬টি, কয়লা ভিত্তিক দু'টি এবং একটি পানি বিদ্যুৎ৷ এটা দেখেই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো অনেক ব্যয়বহুল৷ এখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ৫ দশমিক ৫৯ টাকা আর বিক্রি করা হয় ৪ দশমিক ৮৭ টাকায়৷
এইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার ৩৭৯ মেগাওয়াট৷ এরমধ্যে দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট কেপটিভ বিদ্যুৎ ধরা হয়েছে৷ ক্ষমতার সমান বিদ্যুৎ বাংলাদেশে কখনোই উৎপাদিত হয়নি৷ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয় চলতি বছরের ২৭ মে৷ ঐ দিন রাত ৯টা পর্যন্ত ৯ হাজার ৩৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়৷ এর আগে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ৯ হাজার ২০০ মেগাওয়াট৷
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নানা সমস্যার কারণে যেমন ঘোষিত ক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, তেমনি সঞ্চালন লাইনের ত্রুটির কারণে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে যায় না৷ বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ১৩ দশমিক ১ ভাগ সেকারণে ‘সিস্টেম লস' হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ তাই গড়ে যদি ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তাহলে প্রকৃত উৎপাদন হবে ৭ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি৷
আগামী তিন অর্থবছরের উন্নয়ন খাতের মধ্যে বিদ্যুৎকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে৷ ২০২১ সালের মধ্যে সকলের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে এই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে৷
সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে এই পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে৷ এতে বলা হয়েছে, বিদ্যুতে মোট খরচ ২০ দশমিক ৬ শতাংশ হারে প্রতিবছর বাড়ানো হবে৷ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২২৫ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হবে৷
‘‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ' – এ স্লোগানকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এই বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ ২০২১ সালে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ এছাড়া ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও পরিকল্পনা আছে৷
সরকারের নীতি হিসেবে কয়লা ভিত্তিক এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র এরই অংশ৷ তবে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে চলছে বিতর্ক৷ রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও আছে বিতর্ক৷ এখন প্রশ্ন হলো, সরকার তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে কতটা গুরুত্ব দেবে? সব নাগরিকের বিদ্যুতের চাহিদা কিন্তু এখন মেটালেই হবে না৷ এর জন্য ভবিষ্যতের চাহিদা মাথায় রাখতে হবে৷ সরকার সেটা রাখছে বলেই মনে হচ্ছে৷ কিন্তু সব বিদ্যুৎ এককভাবে দেশেই উৎপাদন সম্ভব কিনা তা জানা যায়নি৷ ভারত থেকে বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন ৬০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আমদানি করছে৷ এখন আরো এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনার কথা চলছে৷ তবে বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন আঞ্চলিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে৷
নেপাল, ভুটান থেকেও বিদ্যুৎ আনার সমঝোতা হয়েছে৷ ভারত বিদ্যুতের করিডোর দিতে প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছিল৷ কিন্তু সম্প্রতি ভারত আইন পরিবর্তন করেছে৷ ভারত এখন নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ নেবে৷ সেখান থেকে বাংলাদেশও নেবে৷ তবে এতে খরচ বাড়বে৷ নেপালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে৷ মিয়ানমার থেকেও বিদ্যুৎ আনার আলোচনা চলছে৷ এগুলো বেশ ভালো উদ্যোগ বলেই ধারণা করা হচ্ছে৷
বিদ্যুৎ নিয়ে বর্তমান সরকারের নানা সমালোচনা করা হলেও, তাদের ধন্যবাদও দিতে হবে৷ কারণ বিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দিয়ে উৎপাদন বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুনে সংসদে দাবি করেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের সময়ে দেশে মোট ১৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে গত আট বছরেই উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট বেড়েছে৷ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৬১ শতাংশই অর্জিত হয়েছে ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে৷ তারপরও বলা হচ্ছে, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো আর প্রকৃত উৎপাদন এক নয়৷ এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জনসংখ্যা৷ বাড়ছে শিল্প কারখানাও৷ তবে প্রকৃত সাফল্য তখনই আসবে যখন সবাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবেন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷