কলকাতা বইমেলায় রাজনীতির বই এবং মুক্তচিন্তা
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩তাই বাংলাদেশের আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটি কেন নেই- এই প্রশ্ন আরো বড় হয়ে উঠছে কারো কারো মনে৷
শীতশেষের পার্বণে কলকাতা বইমেলায় জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক চর্চার উত্তাপও৷ তবে মেঠো বক্তৃতায় নয়, শব্দের মিছিলে৷
‘মিছিল নগরী'র তকমা রয়েছে কলকাতার৷ চাপানউতোর চলতেই থাকে বিবদমান শিবিরে৷ সেই ধারাতে বাঙালির জ্ঞানচর্চা থেকে রাজনৈতিক আলাপকেও আলাদা করা যায় না৷ দশকের পর দশক ধরে বইয়ের পাতায় তার নজির ছড়িয়ে রয়েছে৷
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই আলোচনা, বিতর্কের ইন্ধনকে এক ছাতার নীচে পাওয়ার সুযোগ বইমেলায়৷ প্রেস কর্নারে রোজই প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন বই৷ এই সম্ভার আলো করে আছে রাজনৈতিক গ্রন্থ, স্মৃতিকথা, ইতিহাস ইত্যাদি৷ নয়া প্রকাশনার সঙ্গে আছে পুনর্মুদ্রণও৷
দেশ থেকে বিদেশ, সমাজ-রাজনীতির নানা ওঠাপড়ার দলিল নেড়েচেড়ে দেখছেন পাঠকরা৷ স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরও দেশভাগ নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে৷ ‘গাঙচিল' ছেপেছে রাজর্ষি বিশ্বাসের ‘দেশভাগে বঙ্গ সীমান্ত'৷ দে পাবলিকেশনের বই ‘কাটা দেশ কাঁটাতার'৷ লিটল ম্যাগাজিনের শামিয়ানায় ‘অনীক' পত্রিকার বইমেলা সংখ্যার বিষয় ‘দেশভাগ ৭৫'৷
রাজনীতির আলোচনা যেখানে প্রিয় অবসরযাপন, সেখানে ‘ফ্যাসিবাদ' একটি পরিচিত শব্দ৷ এ নিয়ে গভীর চর্চাও চলে নিরন্তর৷ বৃহস্পতিবার ‘অনুষ্টুপ' পত্রিকার যে সংখ্যা বেরিয়েছে, তার মলাট ‘বিষয় ফ্যাসিবাদ'৷ এর সূত্রে চলে আসে রুশ কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ স্তালিনের প্রসঙ্গ৷ প্রয়াত বাম সাংসদ, তাত্ত্বিক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের অনুবাদ ‘স্তালিন উত্তরাধিকার' পাঠকের হাতে৷ ছেপেছে এনবিএ৷
পথ ভিন্ন হয়ে গেলেও বাম রাজনীতিতে হীরেন্দ্রনাথের উত্তরসূরি পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু৷ সিপিএম কেন্দ্রীয় সরকারের অংশীদার হতে না চাওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি৷ দলের সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভুল' আখ্যা দেন তিনি৷ তাতে আলো ফেলেছেন সাংবাদিক দেবারুণ রায়৷ ‘ঐতিহাসিক ভুলের সেই সাত দিন' বইয়ে৷ আরেক সাংবাদিক গৌতম রায়ের বই ‘অলীক মানুষ পার্টির লোক'৷ সাংবাদিক কিংশুক প্রামাণিকের ‘পলিট্রিক্স’-এর সপ্তম খণ্ড বেরোচ্ছে রবিবার৷
ইতিহাসের সঙ্গে সমকালের রাজনীতির হালহকিকত উঠে এসেছে নানা প্রকাশনায়৷ মোদী সরকারের পদক্ষেপে ভারতের গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখে, এই অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা৷ ‘কাউন্টার এরা পাবলিকেশন' ছেপেছে রাষ্ট্রের নিপীড়নের খতিয়ান, সোমনাথ গুহের কলমে৷
বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গেও মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে৷ যদিও বইমেলায় সব পক্ষই হাজির হইহই করে৷ বাম সাহিত্যের বিপুল পসরা রয়েছে৷ ‘গণশক্তি', ‘যুবশক্তি', ‘ছাত্র সংগ্রাম', ‘গণদাবী', ‘এনবিএ', ‘মনীষা' ছাড়াও লিটল ম্যাগাজিনে কট্টর বাম রাজনীতির ম্যানিফেস্টো৷
পাঠক ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়বেন বিজেপি প্রভাবিত ‘ভারতীয় জনবার্তা'র স্টলের সামনে৷ কখনো বা ‘কংগ্রেস বার্তা'র স্টলে আটকে যাবে চোখ৷ ‘ভারত জোড়ো' যাত্রা ও রাহুল গান্ধীর ছবিতে সেজেছে বইয়ের তাক৷
তা হলে বইমেলা কি বিরোধীদের স্বাধীন চিন্তার মরুদ্যান? বিজেপি নেতা, অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ ‘ভারতীয় জনবার্তা'-র স্টলে ছিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মরুদ্যান নয়, কয়েকটা খেজুর গাছ বলতে পারেন! বইমেলায় কয়েকটা স্টল, বই দেখে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর ছবিটা আঁচ করতে গেলে ভুল হবে৷’’
লেখালেখি, ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রে এ রাজ্যে স্বাধীনতা আছে বলে মনে করেন না ড. নজরুল ইসলাম৷ নিজের স্টলে বসে পাঠকের কেনা বইয়ে সই বিলোচ্ছিলেন৷ ডয়চে ভেলেকে প্রাক্তন পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বই লিখে প্রকাশক পাইনি৷ নিজের টাকায় ছাপিয়েছি৷ ২০১২ সালে ‘মুসলিমদের করণীয়' বইটি লিখে হেনস্থার মুখে পড়েছিলাম৷ এরপরও বলবেন স্বাধীনতা আছে?’’
বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের প্রকাশনা নিয়ে আসে পাঠকের বার্ষিক দরবারে৷ প্রকাশকরা মানছেন, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড পরিচালিত মেলায় স্টল পেতে তাদের সমস্যা হয় না৷ সরকারবিরোধী বই প্রকাশ বা বিক্রিতেও কেউ বাধা দেয় না৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির রণ্জিত শূর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশের নজরদারি বেড়েছে৷ আগে ছোট ছোট পদযাত্রা, নাটিকা করতাম ময়দানে৷ এখন অনুমতি মেলে না৷’’
আন্তর্জাতিক বইমেলায় সরকারবিরোধী স্বর চাপা দিতেই এই কৌশল বলে মত বিভিন্ন সংগঠনের৷ যদিও গিল্ড-এর সভাপতি সুধাংশু দে অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া তার প্রতিক্রিয়া, ‘‘ময়দানের মতো অনেক জায়গা এখানে নেই৷ তাই পদযাত্রা, নাটক করলে ভিড় জমে যাবে, তার চাপে পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷ বইয়ের প্রদর্শন হোক, সেটাই মেলার উদ্দেশ্য৷’’
পরিসর ছোট কি বড়, তা নিয়ে বিতর্ক যা-ই থাক, এর মধ্যে স্বল্প পুঁজির প্রকাশকরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ বিবিধ গণমাধ্যম, তথ্যের অপার উৎস যখন হাতের মুঠোয়, সেই সময় ‘অনীক'-এর মতো ছোট প্রকাশনার কাজ কতটা কঠিন? ছয় দশক পার করা পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনীক যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, সেই সময়ের তুলনায় ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন বেড়েছে৷ তাই ভিন্নধারার ভাবনাচিন্তার প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়নি৷’’
অতি দক্ষিণ থেকে সংসদপন্থি বাম, চরম বামপন্থা থেকে বহুত্ববাদী গণতন্ত্র- মতবাদের শত ফুল বিকশিত হয় কলকাতা বইমেলায়৷ তার মধ্যেই আপনার নজরে পড়বেন দশভুজা৷ ফেব্রুয়ারিতে কি অকালবোধন? শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা'র স্টলের থিম দুর্গোৎসব৷ থরে থরে সাজানো তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই৷ এবার তার সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ চাহিদাও ভালো৷
এই বাংলার পাঠককে হাতছানি দেয় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নও৷ সেখানে অধীশ্বর বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান৷ তার রক্ত, ঘামে মেশা মুক্তিযুদ্ধের গন্ধ৷ রয়েছে জাহানারা ইমাম, যতীন সরকার, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন প্রমুখের বই৷ এপারের প্রকাশনাতেও গুরুত্ব পায় প্রতিবেশী দেশ৷ ‘মনফকিরা'-র বই ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পোস্টার' বিরল এক সংযোজন৷ লিখেছেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত৷
এ সব মিলে, কাঁটাতার তুলে বইমেলা যেন এক ‘অলৌকিক ভ্রাতৃত্বের দেশ'৷ পুলিশ, দমকল, ব্যাংক, বিমা, খাবারদাবার, চিকিৎসা পরিষেবা৷ মোবাইল সংস্থার কাউন্টার, টিভি ক্যামেরা, মাথার উপর ড্রোন৷
দুই মলাটের মধ্যে ১২ দিনের ‘কলকাতা কমিউন'!
মেলার নয়টি প্রবেশদ্বার৷ রাজনীতির নানা মত-পথ এসে মিশেছে তাতে৷ লক্ষ লক্ষ পাঠক আসছেন সেই পথে৷ হাঁটছেন ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার মিছিলে৷