কলকাতা এক দূষণ নগরী
২২ জানুয়ারি ২০১৮কলকাতার দূষণ পরিস্থিতি, যতটা জানা যায়, তার থেকে অনেক বেশি খারাপ৷ খারাপ, খুব খারাপ, বিপজ্জনকের সীমারেখা পেরিয়ে এই শহরের দূষণ এখন সহ্যসীমার অনেক ওপরে৷ ব্যস্ত এলাকাগুলোতে তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া লেকের মতো গাছে ভরা জায়গাতেও দূষণের মাত্রা কখনও কখনও অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়৷ কাজেই কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা করা এখন কার্যত প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরার শামিল৷ বলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা৷ বাতাসে অস্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে মারাত্মক দূষণকণা, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ফুসফুসে গিয়ে জমে যায়, রক্তে মিশে যায়৷ কাজেই কলকাতার মেয়র যদি বলে থাকেন যে, এই শহরের পরিবেশ বিশ্বের অনেক শহরের থেকেই ভালো, আদৌ বিপজ্জনক নয়, তা হলে তার থেকে বেশি সত্যের অপলাপ আর হয় না৷ মেয়রের উচিত, বিরোধিতায় না গিয়ে সচেতন হওয়া, সতর্ক হওয়া, দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া৷ পরিষ্কারই বললেন বিশিষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ৷
সম্প্রতি কলকাতার মার্কিন কনসুলেটে বসানো দূষণ পরিমাপের একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র সম্প্রতি জানায়, শহরের অভিজাত পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে দূষণের পরিমাণ স্বাভাবিক সহ্যসীমার অনেক ওপরে এবং কলকাতা বিশ্বের সবথেকে দূষিত শহর বললেও অত্যুক্তি হবে না৷ এই খবরের দু'দিনের মাথায় কলকাতার মেয়র শোভন চ্যাটার্জি রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে দাবি করলেন, মার্কিন কনসুলেটের দাবি মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ ভুল পরিমাপ করেছে তাদের দূষণ নির্ণায়ক যন্ত্র এবং জেনেশুনে সেই ভুল তথ্য প্রকাশ করে কলকাতার মর্যাদা হানি করা হয়েছে৷ এর প্রেক্ষিতে শহরের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, মার্কিন কনসুলেটের ওই যন্ত্রের মাপ যে ভুল, সেটা পুরসভা কী করে জানল! কনসুলেটে বসানো আছে অত্যাধুনিক ডিজিটাল পরিমাপ যন্ত্র, যার ভুল করার সম্ভাবনা প্রায় নেই৷ সেখানে কলকাতার দুটিমাত্র স্বয়ংক্রিয় এবং বাকি ৯টি ম্যানুয়াল দূষণ পরিমাপ ব্যবস্থা আছে, যা গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অকজো হয়ে আছে৷ সেগুলি নাকি ক্যালিব্রেট করা হচ্ছে নতুন করে, যা এক বছরেও শেষ হলো না৷
এছাড়া এই শহরের দূষণ পর্যবেক্ষকরা ২০১৩ সাল থেকেই নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলের দূষণহার পরিমাপ করে যাচ্ছেন এবং তার যা রিপোর্ট, তা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক৷ জানালেন বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বোঝালেন, কেন কলকাতায় দূষণ ক্রমশই বাড়ছে৷ প্রথমত, সারা শহর জুড়ে ফ্লাই ওভার এবং মেট্রো রেলের পথ নির্মাণের কাজ চলছে, যার দরুণ দূষণ বাড়ছে৷ দ্বিতীয়ত, আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ডিজেল চালিত ট্রাক অবাধে যাতায়াত করছে শহরের রাস্তায়৷ এবং প্রায় সব বড় মাপের বাণিজ্যিক যান ডিজেলে চলে৷ দিল্লির মতো সিএনজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসের জ্বালানিতে চলা যান এই শহরে চালু করা যায়নি৷ এর পাশাপাশি আছে কয়লার উনুন, জঞ্জাল পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষতিকর অভ্যাস, যা শীতকালে পরিমণ্ডলে আটকে যায়৷ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে এলে, হাওয়ার গতি কমে গেলেই এই দূষণ জমির ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার মধ্যে আটকে পড়ে, যা প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস বিপজ্জনক করে তোলে৷
সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ জানাচ্ছেন, আজকাল অনেক মোবাইল অ্যাপ দিয়েও দূষণের হার জানা যায়৷ ঠিক যেভাবে এখন নিখুঁত জানা যায় আবহাওয়ার খবর৷ কাজেই কোনও তর্কবিতর্কে না গিয়ে নাগরিকেরা নিজেরাই এখন জানতে পারেন ঠিক কতটা খারাপ পরিবেশের মধ্যে তাঁরা আছেন৷ তাঁরাই বাধ্য করতে পারেন প্রশাসনকে, দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য৷
গতবছরের জুন মাসের ছবিঘরটি দেখুন...