কলকাতার রাস্তায় এখনো চলে 'নিষিদ্ধ' হাতে টানা রিকশা
খাতায়-কলমে হাতে টানা রিকশা নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় হাতে টানা রিকশা চলছে।
যানের নাম ‘রিকশা’
ভারতবর্ষ তখনও স্বাধীন হয়নি। ১৯১৪ সালে কলকাতায় প্রথম দেখা মিলেছিল এই যানের। ঘোড়ার গাড়ির মত চাকা, কিন্তু ঘোড়ায় টানা নয়, এই গাড়ি টানেন মানুষ। নাম ‘রিকশা’
জাপান থেকে
‘রিকশা' শব্দটি এসেছে 'জিন-রিকি-শা' থেকে। জাপানি শব্দ জিন, যার অর্থ মানুষ, রিকি অর্থাৎ শক্তি এবং শা মানে যান— সব মিলিয়ে মানব-চালিত যান। এই মানবচালিত যানের ব্যবহার জাপানে বহু আগে থেকেই ছিল। পরে তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চালু হতে থাকে।
ভারতে প্রথম কবে?
কলকাতায় কিছুটা দেরিতেই এসেছিল মানুষে টানা ‘রিকশা’। ভারতে প্রথম এমন গাড়ি চলেছিল সিমলায়। তবে সিমলায় রিকশাগুলি ছিল অনেক লম্বাটে। পরে সিমলায় এই রিকশা বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতায় আসার পরে প্রথম কয়েক বছর তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি এই হাতে টানা গাড়ি। বাঙালি বাবুরা একে এড়িয়েই চলেছিলেন। ততদিন প্রধানত মালপত্র বহনে আর চিনাপাড়ায় সীমাবদ্ধ ছিল রিকশার গতিবিধি।
কলকাতায় কবে এলো?
১৮৯০-এ চিন থেকে জাপানি রিকশার কাঠের সংস্করণটি ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় প্রথম আমদানি করেন এক ইহুদি ব্যবসায়ী। এর পর ১৯৩৩-এ ছয় হাজার টানা রিকশাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে রিকশার জনপ্রিয়তার সঙ্গে বাড়তে থাকে রিকশার সংখ্যাও।হাতে টানা রিকশার ভাড়াও যথেষ্ট বেশি। একশ-দেড়শ টাকার কমে তারা যেতে চায় না। তা সত্ত্বেও মানুষ তাতে চড়ছেন। এই রিকশা মূলত দেখতে পাওয়া যায় মধ্য ও উত্তর কলকাতায়।
বাতিল হলেও বন্ধ হয়নি
কলকাতা শহরে হাতে টানা রিকশা বাতিল হয়েছে ২০০৬-এর অগাস্টে, স্বাধীনতা দিবসের দিন। সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হাতে টানা রিকশা তুলে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। তারপরেও হাতে টানা রিকশা বন্ধ হয়নি। এখনো’ শহরের বেশ কিছু অংশে দেখা যাচ্ছে হাতে টানা রিকশার অবাধ চলাচল। যদিও পরিবহণ দফতরের দাবি, নতুন করে হাতে টানা রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয় না। পুরনোদের লাইসেন্স নবীকরণও করা হয় না।
'অমানবিক শ্রম'
হাতে টানা রিকশা কতটা মানবিক এই নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উপল চক্রবর্তী কথায়, ''কায়িক শ্রমকে শোষণ করে একটা গোটা সভ্যতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটা সমাজের বিভিন্ন স্তরে হয়। রিকশাওয়ালাদের অমানবিক শ্রমটা আমাদের চোখে ধরা পড়ছে, কিন্তু এমন বহু কায়িক শ্রম প্রতিদিন শোষিত হচ্ছে যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। কিছু মানুয এই রিকশায় চড়ে একটা প্রভুত্বের আমেজ পান।''
'পুনর্বাসন না দিয়ে বন্ধ করাও অমানবিক'
মানবাধিকার কর্মী সঙ্গীতা চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, “পুনর্বাসন না দিয়ে এইভাবে কোনও পেশাকে বন্ধ করে দেয়া শুধু অন্যায়ই নয়, মানবতা বিরোধীও। এখনও যাঁরা রিকশা চালাচ্ছেন, তাঁদের রিকশাগুলির আধুনিকীকরণ করে চালকদের শ্রমলাঘব করা যায়। এতে শহরের ঐতিহ্যও বজায় থাকে আর সময়ের দ্রুততার সঙ্গে পাল্লাও দেওয়া যেতে পারে।”
পুলিশের দাবি
এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের দাবি, শহরে এখন এক জনেরও হাতে টানা রিকশার লাইসেন্স নেই। কিন্তু প্রায় হাজার পাঁচেক এমন রিকশা চলছে কলকাতার পথে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও মানবিকতার খাতিরে পুরনো রিকশাওয়ালাদের বিরুদ্ধে ‘কড়া’ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
মাসোহারার ব্যবস্থা?
হাতে টানা রিকশা চালান হরিন্দর। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে মহানগরীর পথে রিকশা চালাচ্ছেন। বলছেন, “আজ রিকশা বে-আইনি, তাই পুলিশ ধরলেই টাকা নেয়। যখন আইনি ছিল তখনও টাকা নিত। যেসব রিকশা-মালিকেরা পুলিশের সঙ্গে ‘মাসোহারা’-র ব্যবস্থা করে রেখেছে তাদের রিকশার জন্য ছাড় আছে।”
রিকশাওয়ালার পরবর্তী প্রজন্ম
কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘যে হাজার পাঁচেক রিকশাওয়ালা রয়েছেন, অধিকাংশেরই বয়স হয়েছে। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের বেশিরভাগই এই পেশায় আসেননি। ফলে কালের নিয়মে হাতে টানা রিকশা কমে আসছে, কয়েকবছর পর তা আর থাকবেই না। আইনত নিষিদ্ধ হলেও মানবিকতার কারণে সরকার জোর করে তা বন্ধ করতে চাইছে না।’’
রিকশার আঁতুড়ঘর
বৌবাজার অঞ্চলের দুর্গা পিতুরি লেনে এখনও রিকশা তৈরি হয়। চল্লিশবছর ধরে রিকশা বানানোর পেশায় আছেন ইন্দ্রজিৎ শর্মা। এখন একটা নতুন রিকশা তৈরি করাতে খরচ হয় ২৫হাজার টাকা। তবে আক্ষেপের সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ জানালেন, নতুন রিকশা খুব একটা তৈরি করায় না কেউ, বেশিরভাগই মেরামতির কাজ চলে।
রিকশা যখন ত্রাতা
উত্তর কলকাতার এক শহরবাসী কাবেরী দাস বললেন, “বৃষ্টিতে যখন শহরের অলি–গলি জলে ভরে যায়, তখন আজও আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা এই রিকশাই। লোকে বলে বটে যে মানুষে টানা রিকশা অমানবিক কিন্তু আমরা না উঠলে ওদের পেট চলবে কী করে?”
আন্দোলনেও রিকশা
আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে গত কয়েকমাস আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শহর কলকাতা। সব ক্ষেত্রের মানুষই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন তাঁদের মতন করে। পিছিয়ে থাকেননি এই হাতে টানা রিকশাওয়ালারাও। তাঁদের রোজগারের মাধ্যমকেই আন্দোলনের হাতিয়ার করেছিলেন সেদিন। হাতে টানা রিকশা নিয়ে শহরের বুকে মিছিল করেছিলেন একঝাঁক রিকশাওয়ালা।